মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে এবার বিজেপির বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
সোমবার (২০ জুন) রাজ্য বিধানসভায় নূপুরের বিরুদ্ধে এই নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়। বিধানসভার অধিবেশনের শুরুতে এই প্রস্তাব পেশ করেন রাজ্যটির শিল্পমন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী। রাজ্যের পক্ষে অভিযোগে ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বহিষ্কৃত নেত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে।
এদিন নূপুর শর্মা প্রসঙ্গে বিজেপির বিরুদ্ধে উস্কানি ও ঘৃণার রাজনীতি করার অভিযোগ তোলেন মমতা ব্যানার্জী। সেই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই ইস্যুতে রাজ্যে যেখানে যেখানে সহিংসতা দেখা দিয়েছে রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু নূপুর শর্মা এখনও গ্রেপ্তার হলেন না কেন? আমি জানি যে তিনি কখনোই গ্রেপ্তার হবেন না। আজকেই তার কলকাতা পুলিশের সামনে হাজিরা দেয়ার কথা ছিল, কিন্তু কলকাতা পুলিশের কাছে তিনি চার সপ্তাহ সময় চেয়েছেন।’
এরপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা সব বিধায়ককে আবেদন জানান তারা যেন সবাই মিলে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। তারপরই এই নিন্দাসূচক প্রস্তাবটি বিধানসভায় পাস হয়।
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জী বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ রাজ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা চলছে। তবে সারাদেশে যেভাবে সম্প্রতি নষ্টের চেষ্টা হয়েছে, এর মূল লক্ষ্য হল কর্মসংস্থান ও উন্নয়ন থেকে নজর ঘোরানোর চেষ্টা। ধর্মের নামে বিজেপির এক নেত্রীর মন্তব্যের জেরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা চলছে। এর বিরুদ্ধে অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।’
প্রসঙ্গত, ভারতের এক টেলিভিশন শো’তে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং তার স্ত্রী বিবি আয়েশা (রা.)-কে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছিল নূপুর শর্মার বিরুদ্ধে। এরপর তাকে সমর্থন করে টুইট করে বিতর্ক ছড়িয়েছিলেন দলের আরেক মুখপাত্র নবীন জিন্দাল। যে ঘটনায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ভারতজুড়ে। ফলে দেশ-বিদেশে চাপের মুখে পড়ে মোদি সরকার। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তীব্র প্রতিবাদের মুখে নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালকে ছয় বছরের জন্য দল থেকে সাসপেন্ডও করে বিজেপি। তবে সাসপেন্ড করা হলেও কোনো এক অদৃশ্য রক্ষাকবচের জেরে গ্রেপ্তার করা হয়নি তাদের।
অভিযুক্ত নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লাগাতারভাবে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, আন্দোলন, আবার কোথাও কোথাও তা সহিংসতার রূপ নেয়। নূপুর শর্মা ও নবীন জিন্দালের গ্রেপ্তারের দাবি জানায় মমতা ব্যানার্জীও।
এছাড়া রাজ্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালক দায়ী করে কলকাতার নারকেলডাঙ্গা থানায় এফআইআর করেছিলেন এক ব্যক্তি। তারই ভিত্তিতে গত ১৩ জুন নূপুরের বিরুদ্ধে সমন জারি করে নারকেলডাঙ্গা থানা এবং সোমবার (২০ জুন) থানায় হাজিরার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তাকে। যদিও নিরাপত্তার বিষয় তুলে ই-মেইলের মাধ্যমে অতিরিক্ত চার সপ্তাহ সময় চেয়েছেন তারা। এ সময় বিধানসভায় উপস্থিত বিজেপি বিধায়কের হই-হট্টগোল শুরু করে দেন।
একইদিন সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ যোজনা অগ্নিপথ নিয়েও উত্তাল হয়ে উঠে বিধানসভা। অগ্নিপথ ইস্যুতে যখন সরগরম গোটা দেশ। সেই আঁচ এসে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও।
সোমবার বিধানসভার অধিবেশন কক্ষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বিজেপিকে তীব্র আক্রমণ করে বলেন, ‘কেন্দ্রের অগ্নিপথ প্রকল্প সেনা চাকরি নয়। তা আসলে বিজেপির ক্যাডার তৈরির চেষ্টা।’ মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যে বিধানসভায় তীব্র প্রতিবাদ জানায় বিজেপি বিধায়করা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে ওয়াক আউট করেন গেরুয়া শিবিরের বিধায়করা। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ভারতীয় সেনাকে অপমান করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা।
এদিন সামগ্রিকভাবে এই ইস্যুতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে তীব্র আক্রমণ করেন মুখ্যমন্ত্রী। ২০২৪-এর এর লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এই কাজ করছে বিজেপি, তাও একবার স্মরণ করান তিনি। বলেন, কিসের অগ্নিপথ? দুই কোটি লোকের চাকরি দেবেন বলেছিলেন। এই যুবকরা কী ৪ বছর পর ললিপপ নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন? বিরোধী দলনেতার শুভেন্দু অধিকারীকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, আমরা জানি কিভাবে মেদিনীপুরে চাকরি হয়েছে। মানুষই খোঁজ করে জবাব দেবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আর্মি এলো কোথায় থেকে। দেশ পরিচালনায় সামগ্রিক ব্যর্থতার মধ্যে মুখ রক্ষার জন্য আর্মিকে সামনে আনা হয়েছে। দেশে কিছু বিজেপি গুন্ডা তৈরি করার জন্য এই প্রকল্প। এটা ভ্যান্ডালিজম ছাড়া কিছু না। এটা প্রতিরক্ষা থেকে ঘোষণা হয়নি, হোম মিনিস্ট্রি থেকে করেছে। ৪ বছর বছর পর চাকরি চলে যাবে।’
সারাদেশে আগুন নিয়ে খেলা চলছে। বিজেপির প্ররোচনায় পা দেবেন না বলেও এদিন দলীয় বিধায়ক ও রাজ্যের মানুষকে সতর্ক করেন মমতা।
সম্প্রতি মমতার দলের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ১৭ হাজার মানুষকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি চাকরি দেয়ার বিষয়টি সামনে এসে। মন্ত্রীকন্যাসহ একাধিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করে হাইকোর্ট। এদিন সেই প্রসঙ্গেও বিরোধীদের প্রশ্নের মুখে উত্তাল হয়ে উঠে বিধানসভা।