দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক সঙ্কটে ভোগার পর তীব্র বিদ্রোহের আগুনে পুড়ছে শ্রীলঙ্কা। নজিরবিহীন মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শেষ, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশ-ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছে লংকানরা। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র বিরোধের মুখে সপ্তাহ দুয়েক আগে পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। এরপর ক্ষমতায় এসেছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। ক্ষমতাসীন হয়ে কি করছেন তিনি, এখন কি অবস্থা বিরাজ করছে শ্রীলঙ্কায় তা জানার চেষ্টা করব আজ।
শুরুতেই শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার পেছনের কারণ নিয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। বস্তুত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণেই শ্রীলঙ্কা প্রায় বছর তিনেক আগেই দ্বৈত অর্থনৈতিক ঘাটতির মুখে পড়েছিল। অর্থাৎ আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি ছিল সরকারের। তারপর ২০১৯ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময় রাজাপাকসের বিরাট কর ছাড়ের প্রতিশ্রুতির ও ক্ষমতায় এসে তা বাস্তবায়নের পরপরই মহামারি করোনায় শ্রীলঙ্কার পর্যটন শিল্প ধাক্কা খায়। মাত্রাতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি ঠেকাতে ব্যাপক পরিমাণে কমতে যায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশের ধুঁকতে থাকা এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর শেষ আঘাত ছিল ২০২১ সালে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। কৃষিক্ষেত্রে এর ফল হয়েছে মারাত্মক। খাদ্যশস্য উৎপাদনে দেখা দেয় ব্যাপক ঘাটতি।
সবমিলিয়ে তীব্র বিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসের স্থলাভিষিক্ত হন রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে গেল ১২ মে বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে রনিলকে শপথ পাঠ করান। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি নেতা ৭৩ বছরের রনিল বিক্রমাসিংহে এর আগে আরো পাঁচবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশের এই সংকট কাটিয়ে উঠতে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জোট সরকার গঠন করার কথা বলে যাচ্ছিলেন। বিরোধী দলের নেতা রনিলকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার অর্পণ তার সেই ইচ্ছার বাস্তব প্রকাশ। রনিল নিজেও তার মন্ত্রিসভায় সব দলের সদস্যদের রাখার কথা বলেছেন।
ক্ষমতায় এসেও তীব্র বিরোধের মুখে পড়েন রনিল বিক্রমাসিংহে। বিক্ষোভ প্রশমনে রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে রনিল বিক্রমাসিংহে বিবিসিকে বলেন, পরিবারগুলো যাতে দিনে তিন বেলা খেতে পারে, তা নিশ্চিত করবেন তিনি। বিশ্বের কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশে দুর্ভিক্ষ হবে না, আমরা খাদ্য পাব।’ আরও বলেন, ‘ইতিবাচক ধারায় ফেরার আগে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি আরও খারাপ হতে পারে।’
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে বলে মন্তব্য করেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তবে তিনি লংকানদের বলেন, ‘ধৈর্য ধরুন, আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করব।’ সে সময় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চেয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এক বছরের জন্য আপনাদের সহায়তা আমাদের প্রয়োজন। আমরা যা-ই আপনাদের কাছ থেকে পাব, তা শোধ করে দেব।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পর নতুন চার মন্ত্রী নিয়োগ দেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। এই চারজনই গত মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। কিন্তু ফাঁকা রাখা হয় অর্থমন্ত্রীর পদ। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়ে সর্বদলীয় সরকার গড়তে বিরোধী দলের উদ্দেশে চিঠি লেখেন রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রধান বিরোধী দলের নেতা সাজিথ প্রেমাদসাকে লেখা চিঠিতে সর্বদলীয় সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানান।
ক্ষমতায় এসেই দেশকে সংকট থেকে বের করে আনতে কাজ শুরু করেন তিনি। গেল ১৬ মে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বিক্রমাসিংহে বলেন, অতি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য শ্রীলঙ্কার এখন জরুরিভাবে সাড়ে সাত কোটি ডলার প্রয়োজন। সে সময় তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমাদের হাতে মাত্র এক দিনের পেট্রল আছে। আগামী কয়েক মাস আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় হবে।’
সেদিনই আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা বিক্রি করে এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য কাগজের মুদ্রা ছাপানোর সিদ্ধান্তের কথা জানান রনিল। সোমবার (১৬ মে) টেলিভিশন ভাষণে তিনি বলেন, নতুন সরকার ‘শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস’কে বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং বেতন দেয়ার জন্য কাগজের মুদ্রা ছাপতে যাচ্ছে। পরদিন মঙ্গলবার সংসদ অধিবেশনে দেশের সংকটময় পরিস্থিতি উত্তোরণের বিষয়ে আলোকপাত করেন তিনি। এই অধিবেশনেই ভারতের এক্সিম ব্যাংকের কাছে ৫০ কোটি ঋণ চাওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
পরদিন বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণখেলাপি হওয়ার ঘোষণা দেয় শ্রীলঙ্কা। ৭০ বছরের ইতিহাসে দ্বীপদেশটি এই প্রথম ঋণখেলাপি হলো। ওইদিন এক সার্বভৌম ঋণের বিপরীতে প্রায় আট কোটি ডলার কিস্তি পরিশোধ করার কথা ছিল শ্রীলঙ্কার। একদিন পর শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দুই সপ্তাহ ধরে চলা জরুরি অবস্থা তুলে নেয় রনিল সরকার। শুক্রবারেই ভয়াবহ আর্থিক সংকটে শ্রীলঙ্কায় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী। পরের মৌসুমে উৎপাদন বাড়াতে সরকার যথেষ্ট সার আমদানি করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
এরইমধ্যে রনিলের যোগাযোগে ভারত থেকে তেল, চাল, ওষুধ ও গুড়ো দুধের মতো জরুরি পণ্যের সহায়তা পৌঁছে শ্রীলঙ্কায়। তারপরই রনিলের নির্দেশে দেশজুড়ে জ্বালানি তেল মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো শুরু করে প্রশাসন। এরপর সোমবার আরও আটজন নতুন মন্ত্রী যোগ হয় রনিল বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিসভায়। তবে তখনও অর্থমন্ত্রীর পদ খালি রাখেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে।
তীব্র জ্বালানি সংকটে গেল ২৪ মে মঙ্গলবার থেকে সরকারি অর্থায়ন সংস্কার এবং আর্থিক সংকট মোকাবিলায় জ্বালানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় শ্রীলঙ্কা। পেট্রলের দাম ২০ থেকে ২৪ শতাংশ এবং ডিজেলের দাম ৩৫ থেকে ৩৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। প্রত্যেক ভোক্তা কতটা কিনতে পারবেন তার দৈনিক সীমা অব্যাহত থাকবে। এমনকি দেশে জ্বালানির ব্যবহার কমাতে বাড়ি থেকে কাজ করার কথাও বলে সরকার।
এরপর গত ২৫ মে এতদিন ধরে খালি থাকা অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব কাঁধে নেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজেই। প্রবীণ রাজনীতিবিদ রনিল বিক্রমাসিংহে অর্থমন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব পাওয়ায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে পারবেন তিনি।
শপথ গ্রহণের পর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে রনিল বলেছিলেন, ‘আমরা একটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অবশ্যই এর মধ্য থেকে বের হতে হবে।’ চলমান সংকট সমাধানের কোনো উপায় আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই আছে।’
গোটবায়া-রনিল জোট সরকার শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক এই সংকট থেকে টেনে তুলতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়। শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট এবং তার জেরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করাই রনিলের জন্য এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।