আজ (বৃহস্পতিবার) ভোর থেকে শুরু হওয়া ‘সর্বাত্মক লকডাউনে’ রাজধানীর রাজপথ অনেকটাই ফাঁকা। সরকারি ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের গাড়ি, পণ্যবাহী বাহন ছাড়া কিছু রিকশা-রিকশাভ্যান চলছে বিভিন্ন রাস্তায়। কিছু কিছু ব্যক্তিগত গাড়ি চলতে দেখা গেলেও সংখ্যায় তা একেবারেই কম।
রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেক পোস্ট ছাড়াও কাঁটাতারের ব্যারিকেড বসিয়েছে পুলিশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় থাকতে দেয়া হচ্ছে না। সকালে গুলশান, রামপুরা ও হাতিঝিল এলাকায় সেনাবাহিনীর টহলওদেখা গেছে।
এই বিধিনিষেধের মধ্যে জরুরি কারণ ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে যে কঠোর শাস্তির মুখে পড়তে হবে, সে বিষয়ে সতর্ক করা হচ্ছিল কয়েক দিন ধরেই।
ঢাকার পুলিশ কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, কেউ বিধি-নিষেধ ভঙ্গ করলে দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাস্তায় কোনো ব্যক্তিগত যানবাহনও চলবে না। চলতে পারবে শুধু রিকশা।
দণ্ডবিধির ২৬৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি বেআইনিভাবে বা অবহেলা করে এমন কোনো কাজ করেন, যা জীবন বিপন্নকারী মারাত্মক কোনো রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে, তা জানা সত্ত্বেও বা বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও তা করেন, তাহলে তাকে ছয়মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড, বা অর্থদণ্ড, অথবা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
মানুষকে বিধিনিষেধ মানাতে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি টহলে রয়েছে। মাইকে সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হচ্ছে।
লকডাউনে যা বন্ধ, যা খোলা
>> সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে।
>> সড়ক, রেল ও নৌপথে গণপরিবহন (অভ্যন্তরীণ বিমানসহ) ও সব যন্ত্রচালিত যানবাহন, শপিংমল, মার্কেটসহ সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে।
>> বন্ধ থাকবে সব পর্যটন কেন্দ্র, রিসোর্ট, কমিউনিটি সেন্টার ও বিনোদন কেন্দ্র।
>> জনসমাবেশ হয় এমন সামাজিক (বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান-ওয়ালিমা, জন্মদিন, পিকনিক, পার্টি ইত্যাদি), রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
>> আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং জরুরি পরিষেবার যানবাহন চলাচল করতে পারবে।
>> জরুরি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মচারী ও যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়পত্র প্রদর্শন দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
>> বরাবরের মত পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত যানবাহন নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।
>> আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চললেও বন্ধ থাকবে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট।
>> বিদেশগামী যাত্রীরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণের টিকেট দেখিয়ে গাড়ি ব্যবহার করে যাতায়াত করতে পারবেন।
>> এ সময় বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থল বন্দর এবং সংশ্লিষ্ট অফিস নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
>> শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে।
>> কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা-বেচা করা যাবে।
>> খাবারের দোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খাবার বিক্রি (অনলাইন/টেকওয়ে) করতে পারবে।
>> অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।
>> নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
>> যারা করোনাভাইরাসের টিকার তারিখ পেয়েছেন, টিকা কার্ড দেখিয়ে তারা কেন্দ্রে যাতায়াত করতে পারবেন।
লকডাউনের প্রথম দিন সকালে মগবাজার মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়া পল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মীরপুর, আজিমপুর, বাড্ডা, রামপুরা, শাহবাগ, ধানমন্ডি, হাতিরপুল ঘুরে মোড়ে মোড়ে পুলিশ চেকপোস্ট দেখা গেছে।
কাকরাইলের মোড়ে পুলিশের একজন কর্মকর্তা একটি সাদা প্রাইভেট কার থামিয়ে বলেন, ‘‘ভাই, কেন বের হয়েছেন? জানেন না লকডাউন চলছে? কেন নিজে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন, অন্যদেরকে বিপদে ফেলছেন?”
ওই পুলিশ কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, “ঘর থেকে বের হওয়ার যুক্তসঙ্গত কারণ না দেখালে মামলা, জেল-জরিমান মুখে পড়তে হবে। কোনো ছাড় আমরা দিচ্ছি না, কড়াকড়ি করছি।”
আজিমপুর চৌরাস্তায় এক পুলিশ কর্মকর্ত জানান, সকাল থেকেই ব্যারিকেড দিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। ‘অতি প্রয়োজন’ ছাড়া কাউকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। মোটরসাইকেলে দুজন যাত্রী দেখলে একজনকে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে, কেন তারা বের হয়েছেন তাও জানতে চাওয়া হচ্ছে।
লকডাউনে যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলে নিষেধ থাকলেও রিকশায় বাধা নেই। সকাল থেকে বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে রিকশা চালকরা বসে থাকলেও যাত্রী পাচ্ছেন না। তার মধ্যে চলছে বৃষ্টি।
মালিবাগ মোড়ে রিকশা চালক জামাল বলেন, ‘‘ স্যার গত কয়েকটা দিন ভালো কামাই হয়েছে। কিন্তু আইজ সকাল থেকে খ্যাপ পাই নাই। কীভাবে চলমু?”
রিকশাচালকরা জটলা করে বসে থাকলে মাঝে মধ্যে পুলিশ সদস্যরা হুইসেল বাজিয়ে তাদের সর্তক করছেন।
অফিস আদালত বন্ধ থাকলেও শিল্পকারখানাগুলো ‘নিজস্ব ব্যবস্থায়’ চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার। সকালে পোশাক শ্রমিকদের অনেককে পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যতে দেখা যায়। তাদেরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হচ্ছে।
সকালে মীরপুরে কারখানায় যাওয়ার পথে পোশাককর্মী তাছলিমা বেগম বললেন, ‘‘লকডাউন হোক আর যাই থাকুক, কাজে তো যেতে হবে। রিকশা ভাড়া দিয়ে তো পোষাবে না। তাই হেঁটে যাচ্ছি।”
অলি-গলি ফুটপাতে কিছু দোকানপাটও খোলা দেখা গেল। তবে ক্রেতা নেই বললেই চলে।
খাবারের দোকানগুলোতেও মানুষজনকে ভিড় করতে দেয়া হচ্ছে না। শান্তিনগর বাজারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কিছুক্ষণ পর পর বাজার ঘুরে দেখছেন সবাই মাস্ক পড়ছে কিনা, কোনো দোকানে জটলা আছে কিনা।
সেখানে দেখা গেল তরকারি-শাক-সবজি নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছেন কয়েকজন বিক্রেতা। তাদের একজন কলিমউদ্দিন বললেন, ‘‘ কাস্টমার কম। লকডাউনের কারণে আমরা বাজারের ভেতরে না গিয়ে রাস্তার পাশে খোলা জায়গায় বসে বিক্রি করছি।”