২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১০ জনকে বিচারিক আদালত ফায়ারিং স্কোয়াডে হাইকোর্টের অনুমোদন সাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেন। এর আগে দেশে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে হবে এমন বিধান অনুসরণ করে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হত।
এখন এ মামলায় কীভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
সোমবার (৯ আগস্ট) এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করা হয়। রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১০ জনকে বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
রায়ে আদালত বলেছেন, গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নজির যেহেতু খুব একটা দেখা যায় না, সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয় পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করে তা কার্যকর করতে পারে।
রায়ে বলা হয়, অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৮(১) ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে হবে। উক্ত ধারা অনুসরণ করেই বিচারিক আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে থাকে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪এ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দু’ধরনের বিধান সন্নিবেশিত রয়েছে। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে গলায় রশি ঝুলিয়ে অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিতে পারে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একমাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় উভয় পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করার কথা বিচারিক আদালত আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াডে জনগণের উপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে না থাকায় হাইকোর্ট বিভাগ ওই আদেশ পরিবর্তন করে শুধু দণ্ডিত ব্যক্তির গলায় রশি ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন।
রায়ে বলা হয়, বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪এ ধারায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দু’ধরনের পদ্ধতি থাকলেও বর্তমান মামলায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসরণ পূর্বক দণ্ডিতদের গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দেন। এ ধরনের পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নজির যেহেতু খুব একটা দেখা যায় না সেক্ষেত্রে আমরা মনে করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উভয় পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করে তা কার্যকর করতে পারে। সুতরাং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর সম্পর্কিত আদেশ উক্ত রূপে পরিবর্তন করা হলো।
চলতি বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি রায়টি দেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এ মোহাম্মদ শাহীন মৃধা। পলাতক আসামিপক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত ছিলেন আইনজীবী অমূল্য কুমার সরকার। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও মোহাম্মদ আহাসান, ইমাদুল হক ও নাসির উদ্দিন।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক ওরফে মারফত আলী, রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান ওরফে শিমন খান, ইউসুফ ওরফে মোসাহাব মোড়ল ওরফে আবু মুসা হারুন, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই ও মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ওমর।
আসামি মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী খানকে বিচারিক আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১৪ বছরের দণ্ডিত আসামি আনিসুল ইসলামের দণ্ড বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত।
তবে ১৪ বছরের দণ্ডিত মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানের দণ্ড বহাল রেখে আদালত বলেন, দেখা যাচ্ছে শ্যোন এরেস্ট দেখানোর পর থেকে তার ১৪ বছর দণ্ড ভোগ করা হয়ে গেছে। তাকে বিচারিক আদালত ১৪ বছর দণ্ডের পাশাপাশি ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন। সুতরাং জেল কোড অনুসারে এ আসামি তার ওপরে প্রদত্ত দণ্ড যদি ভোগ করে থাকেন তবে তাকে মুক্তি দিতে (যদি অন্য কোনো মামলা না থাকে) নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া ১৪ বছরের অপর দণ্ডিত আসামি সারোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দিয়েছেন উচ্চ আদালত। যদি অন্য মামলা না থাকে তাহলে তাকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন।
গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর এ আপিল শুনানি শুরু হয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি শুনানি শেষে রায়ের জন্য ১৭ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) দিন ধার্য করা হয়েছিল। সে অনুসারে রায় ঘোষণা করা হয়।
২০০০ সালে কোটালীপাড়া সফরের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। সমাবেশের দু’দিন আগে ২০ জুলাই কলেজ প্রাঙ্গণে জনসভার প্যান্ডেল তৈরির সময় শক্তিশালী বোমার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
পরে ওই কলেজের উত্তর পাশে সন্তোষ সাধুর দোকানঘরের সামনে থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল ৭৬ কেজি ওজনের বোমাটি উদ্ধার করে। পরদিন ২১ জুলাই গোপালগঞ্জ সদর থেকে ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি শক্তিশালী বোমা উদ্ধার করা হয়।
এসব ঘটনায় আলাদা দু’টি মামলা দায়ের করা হয়। ২০১০ সালে মামলা দু’টি ঢাকার ২ নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। জঙ্গি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ মামলা থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
২০১৭ সালের ২০ আগস্ট দুই মামলার একটিতে ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন আদালত।