# বাংলাবাজারে পদ্মা পারের অপেক্ষায় প্রায় ১ লাখ মানুষ # বিধিনিষেধের ৯ম দিনে আটক ৪৮১ # গণপরিবহন চালুর দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সারাদেশে কঠোর লকডাউন চলছে। এর মধ্যেই নতুন করে ঘোষণা আসে শিল্পকারখানা খুলে দেয়ার। এখবর শুনে রাজধানীর বাইওে থেকে বিভিন্ন জেলার মানুষ ছুটতে থাকে রাজধানীতে। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পদে-পদে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে এসব খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিকদের। ফলে গণপরিবহন ছেড়ে দেয়ার দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকরা। যদিও গার্মেন্টস মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কাজে যোগদান না করলেও কেউ চাকরি হারাবে না। কিন্তু শ্রমিকদের অভিযোগ ফোনে যোগাযোগ করে কাজে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ফলে উভয় সংকটের মধ্যেই ভোগান্তি নিয়েই রাজধানীমুখী হচ্ছেন শ্রমিকরা।
এদিকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ফেরিঘাটে প্রায় এক লাখ মানুষ পদ্মা নদী পার হওয়ার অপেক্ষায় আছেন। সেখানে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বেশিরভাগ পোশাক কারখানার কর্মী। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাবাজার ফেরিঘাটের ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. জামাল উদ্দিন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সন্ধ্যা ৬টায় দেড় ঘণ্টা ধরে বাংলাবাজার ঘাটে ফেরি না থাকায়, ঘাটে যাত্রীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এ রুটের ফেরিগুলো আগে অপেক্ষায় থাকা যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়াঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। গতকাল সকাল ১০টার পর থেকে ফেরিতে শুধু মানুষই পার করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, শিমুলিয়াঘাটে যাত্রী আনলোড করার পর দ্রুত খালি ফেরি আসছে বাংলাবাজার ঘাটে। যাত্রীদের জনস্রোত নিয়ন্ত্রণ না করতে পারায় সারাদিনে মাত্র ১০টি অ্যাম্বুলেন্স পার করা গেছে বলেও জানান তিনি।
এসব অপেক্ষমাণ যাত্রীদের বেশিরভাগ গার্মেন্টস কারখানার কর্মী উল্লেখ করে তিনি আরও জানান, ফেরিগুলোতে পা ফেলারও জায়গা নেই। কানায় কানায় পূর্ণ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটের দিকে মানুষের উপস্থিতি বাড়তেই থাকে।
পাশপাশি লকডাউনের মধ্যে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার ঘোষণার পর উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে কর্মস্থলে ফেরার জন্য বঙ্গবন্ধু সেতুর বিভিন্ন স্থানে ভিড় করছেন কর্মজীবী মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাসড়কে ভিড়ও বাড়তে থাকে। গাদাগাদি করে ট্রাকে, মোটরসাইকেলে যে যেভাবে পারছেন, কর্মস্থলে ফিরছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা বলছেন, বাস বন্ধ থাকায় তারা মাইক্রোবাস, ট্রাক, পিকআপ কিংবা ভ্যান, মোটরসাইকেলে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। যাত্রীদের অধিকাংশেরই গন্তব্য টঙ্গী, গাজীপুর, আশুলিয়ার পোশাক কারখানা অধ্যুষিত এলাকা। কোনো ট্রাক আসা মাত্রই তাতে মানুষকে হুমড়ি খেয়ে উঠতে দেখা যায়। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে গাদাগাদি করে চরম দুর্ভোগ পেরিয়ে যে কোনো মুল্যেই নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছাতে চাইছেন তারা।
টঙ্গির একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শ্রমিক জানান, কারখানা থেকে তাদেরকে ফোন করে বলা হয়েছে রোববারেই অফিসে যোগ দিতে হবে। চাকরি বাঁচাতে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি এলাকা থেকে সীমাহীন ভোগান্তি সত্ত্বেও কর্মস্থলের পথে রওনা হয়েছেন তিনি। যানবাহনের জন্য অপেক্ষারত যাত্রীরা প্রত্যেকেই বাস চালু না করে হঠাৎ করে শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। তারা বলেন, কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়েও পরিবহন মিলছে না।
বরিশাল থেকে পোশাকশ্রমিকরা যে যেভাবে পারছেন ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন। রিকশায়, ভ্যানে, পায়ে হেঁটে, ট্রাকে বা ট্রলারে—বিভিন্ন যানবাহনে করে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে আসছেন তারা।
মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ের সামনে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে কয়েকটি কাভার্ড ভ্যানে কয়েকশ কারখানা শ্রমিককে কর্মস্থলের দিকে যেতে দেখা গেছে। একেকটি কাভার্ড ভ্যানে ২০ জনেরও বেশি যাত্রী পরিবারসহ গাদাগাদি করে বসেছেন।
একটি কাভার্ড ভ্যানের চালকের সহকারী লোকমান হোসেন জানান, গত কয়েকদিন ধরেই এভাবে যাত্রী আনা-নেওয়া চলছে। মানিকগঞ্জ থেকে নবীনগর-সাভারগামী কাভার্ড ভ্যানে ২০ থেকে ২২ জন করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৩০০ টাকা। কার্ভাড ভ্যানে বন্দি হয়ে ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের বেশিরভাগই গার্মেন্টস শ্রমিক ও তাদের পরিবার। রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, মাগুরাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে পদ্মা পার হয়ে দৌলতদিয়া দিয়ে ফিরছেন তারা।
অপরদিকে ঢাকায় কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবিতে রংপুর নগরীর মডার্ন মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন হাজার হাজার পোশাকশ্রমিক। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পরিবহন না পেয়ে ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।
স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে রংপুর ও আশপাশের জেলার পোশাকশ্রমিকরা ঢাকায় কারখানায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য নগরীর মডার্ন মোড়ে আসেন। দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকেও যানবাহন পাননি। পণ্যবাহী ও খালি ট্রাকে গন্তব্যে যেতে চাইলে বাধা দেয় পুলিশ। দুপুর ১২টার দিকে মডার্ন মোড় ও আশপাশের এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ সময় হাজার হাজার পোশাকশ্রমিক পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এতে মহাসড়কের দুই পাশে শত শত ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন আটকাপড়ে।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ১৫ দিনের লকডাউনের ঘোষণা দিয়ে সব পোশাক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সুযোগে শ্রমিকরা বাড়িতে চলে আসেন। কিন্তু হঠাৎ শুক্রবার ঘোষণা আসে, রবিবার থেকে কারখানা খোলা। শ্রমিকদের ঢাকায় যাওয়ার পরিবহনের ব্যবস্থা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিত হয়নি সংশ্লিষ্টদের। এখন কীভাবে কর্মস্থলে যাবেন তারা। ১৫ দিন কারখানা বন্ধের কথা শুনে লাখ লাখ শ্রমিক ঈদ উদযাপন করতে রংপুরের বিভিন্ন জেলায় এসেছেন। এখন দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে তাদের কারখানায় যেতে হচ্ছে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেক শ্রমিক। কাজে যোগ না দিলে চাকরি থাকবে না বলে কারখানা থেকে জানানো হয়েছে তাদের।
এদিকে শিল্প-কলকারখানার শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফিরতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সব জেলা ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার এবং দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত লঞ্চ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। শনিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে গার্মেন্টসহ কলকারখানা শ্রমিকদের কর্মস্থলে ফেরার সুবিধার্থে আজ রাত ৮টা থেকে কাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে চলবে সব ধরনের গণপরিবহন। এ কথা জানিয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, শ্রমিকদের স্বার্থে সরকার গণপরিবহন চলাচল শিথিল করেছে।
শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি ফারুক হাসান কারখানা মালিকদের উদ্দেশে বলেন, বিধিনিষেধ পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত কোনো শ্রমিক-কর্মচারী কাজে যোগদান করতে না পারলে তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। কারখানার আশপাশে অবস্থানরত শ্রমিকদের নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সদস্যদের আহ্বান জানাচ্ছি।
অপরদিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের নবম দিনে এসে চাপ বেড়েছে সড়কে। গার্মেন্টস খোলার খবরে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত ছিল দিনভর। এ অবস্থায়ও প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া কিংবা বিভিন্ন নির্দেশনা অমান্যের দায়ে ৪৮১ জনকে আটক করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ২০২ জনকে ২ লাখ ৬ হাজার ৭১০ টাকা জরিমানা করা হয়। শনিবার সকাল থেকে দিনভর ডিএমপির বিভিন্ন থানা এলাকায় একযোগে পরিচালিত অভিযানে তাদের আটক ও জরিমানা করা হয়।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম জানান, কঠোর বিধিনিষেধের নবম দিনে ডিএমপির আটটি বিভাগে বিভিন্ন থানা পুলিশ একযোগে অভিযান অব্যাহত রাখে। বিধিনিষেধ অমান্য করার অভিযোগে সারা দিনে ৪৮১ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ২০২ জনকে ২ লাখ ৬ হাজার ৭১০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এদিকে নবম দিনে বিধিনিষেধ অমান্য করায় ৪৪০টি যানবাহনকে ১০ লাখ ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ।