হোমিওপ্যাথি ও ইউনানি পড়ে কেউ তার নামের আগে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না’—আদেশের ওপর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।
শনিবার (১৪ আগস্ট) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর ৭১ পৃষ্ঠার রায়টি প্রকাশিত হয়।
আদালত রায়ে বলেছেন, ‘দুঃখজনকভাবে এটি লক্ষণীয় যে, এখানে বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইন, ২০১০ এর ২৯ ধারা অনুযায়ী বিএমডিসি এর নিবন্ধনভুক্ত মেডিক্যাল বা ডেন্টাল ইনস্টিটিউট কর্তৃক এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়া অন্য কেউ তাদের নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না।
সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ২০১৪ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিতে ‘অল্টারনেটিভ মেডিক্যাল কেয়ার’ শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের বিভিন্ন পদে কর্মরত হোমিওপ্যাথি, ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক কর্মকর্তাদের স্ব-স্ব নামের পূর্বে ডাক্তর (ডা.) পদবি সংযোজনের অনুমতি প্রদান করেছে, যা এক কথায় আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত তথা বেআইনি। এছাড়া বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ডের ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন শাখায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদেরও তাদের নামের পূর্বে পদবি হিসেবে ডাক্তার ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করাও বেআইনি।’
এতে বলা হয়, ‘বিকল্পধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পেশাধারীরা নামের পূর্বে ১) ইনটেগ্রেটেড ফিজিশিয়ান, ২) কমপ্লিমেন্টারি ফিজিশিয়ান, ৩) ইন্টেগ্রেটেড মেডিসিন প্রাকটিশনার এবং ৪) কমপ্লিমেন্টারি মেডিক্যাল প্রাকটিশনার পদবি ব্যবহার করতে পারেন। পাশের দেশ ভারতেও বিকল্পধারার চিকিৎসকরা (ডা.) লিখতে পারেন না।’
‘সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ মোতাবেক রাষ্ট্রের অন্যতম সাংবিধানিক মৌলিক দায়িত্ব হলো জনগণের জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এছাড়াও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ মোতাবেক অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে রাষ্ট্র জনস্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ নাগরিকের জীবন ধারনের অধিকারকে নিশ্চিত করেছে। সাংবিধানিকভাবে প্রত্যেক ব্যক্তির জীবন তথা বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষিত। সঠিক চিকিৎসা না পেলে নাগরিকের জীবনহানি অবধারিত। সুতরাং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ মোতাবেক চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার’ রায়ে বলেন হাইকোর্ট।’
হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি পাঁচ হাজার বছরের প্রাচীন। সুতরাং পাঁচ হাজার বছর ধরে সারা পৃথিবীতে চলে আসা প্রাচীন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির যথাযথ এবং সঠিকভাবে পঠন এবং প্রশিক্ষণ জনমানুষের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন করবে। প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি তথা পশ্চিমা চিকিৎসা পদ্ধতি আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু হয় আজ থেকে মাত্র ১৬২ বছর আগে। পৃথিবীর প্রথম প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতির আইনটির নাম “দ্যা মেডিক্যাল অ্যাক্ট, ১৮৫৮” যা ইংল্যান্ডের সংসদ পাশ করেছিল। অর্থাৎ ১৮৫৮ সালের পূর্বে চিকিৎসা ব্যবস্থা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল না। অপরদিকে, পাঁচ হাজার বছর পূর্ব হতে মানুষ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করে আসছে।’
এতে বলা হয়, যেহেতু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ মোতাবেক চিকিৎসা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার, সেহেতু আমরা, নিম্নেবর্ণিত পরামর্শসমূহ প্রদান করলাম।
(১) “সবার জন্য স্বাস্থ্য” নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে “কাজাখস্তান ঘোষণা” থেকে “আলমাআটা ঘোষণা” বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সার্বিক পরিকল্পনা, নীতিমালা এবং প্রয়োজনীয় আইন দ্রুত প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হলো।
(২) সার্বিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় তথা প্রচলিত এবং বিকল্প ধারার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় “রোগী কেন্দ্রিক চিকিৎসা সেবা” নীতিমালা অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হলো।
(৩) প্রয়োজনে বিকল্প ধারার চিকিৎসা পদ্ধতির পৃথক মন্ত্রণালয় তথা “মিনিস্ট্রি অব আয়ুশ গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া” এর আদলে বাংলাদেশের একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
(৪) বিকল্প ধারার চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সেবার মান নির্ধারণ ও উন্নয়ন এবং বিকল্প ধারার চিকিৎসা শাস্ত্র সংশ্লিষ্ট বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও তৎপ্রদত্ত ডিগ্রিসমূহকে স্বীকৃতি প্রদান করার পদ্ধতি নির্ধারণ করার পরামর্শ দেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত, এর আগে হোমিওপ্যাথিক ও ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রে ডিগ্রিধারীরা নামের পূর্বে ডাক্তার ব্যবহারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছিলেন। সেই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি করেছিলেন আদালত। এরপর ওই রুলের ওপর শুনানি হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম ও অ্যাডভোকেট খোন্দকার নীলিমা ইয়াসমিন। অপরপক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম।
শুনানি শেষে হোমিওপ্যাথিক ও ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রের ডিগ্রিধারীরা নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে পারবেন না—এমন নিষেধাজ্ঞা দিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। সে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি স্বাক্ষরের পর প্রকাশ করলেন হাইকোর্ট।