বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন

ববিতার নায়ক ওয়াহিদ এখন কোথায়

রিপোর্টারের নাম :
আপডেট : আগস্ট ৭, ২০২২
ববিতার নায়ক ওয়াহিদ এখন কোথায়
বাংলা সিনেমায় ববিতার আফগান নায়ক

ছয় ফুট লম্বা ২২ বছরের তাগড়া সুদর্শন এক আফগান যুবক বাংলাদেশে এসেছে রাষ্ট্রদূত বাবা-মায়ের সঙ্গে। বাংলাদেশে এসেই সেই যুবক শুরু করেন মডেলিং। এদিকে পরিচালক মুশতাক তার পরবর্তী সিনেমার জন্য এমন একজনকে খুঁজছিলেন যাকে দেখলে মনে হবে আমেরিকা ফেরত। আফগান যুবককে প্রথম দেখাতেই মনে ধরে পরিচালকের। আমন্ত্রণ জানান অডিশনের জন্য।

অডিশনে আফগান যুবকের পারফরম্যান্সে বেজায় খুশি মুশতাক- এরপর ১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় জনপ্রিয় সিনেমা ‘বন্দিনী’। সিনেমায় সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া ‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না’ গানটি শোনেননি এমন বাংলাদেশি শ্রোতা খুব কমই পাওয়া যাবে। সেই সিনেমায় ববিতার সঙ্গে আফগান সেই যুবককে দেখে চমকে উঠেন দর্শকরা। ববিতার সঙ্গে এ বিদেশি নায়কটা কে!

হ্যাঁ, বলছিলাম চিত্র নায়ক ওয়াহিদ কাদিরের কথা। ববিতার সঙ্গে অভিনয় করা এই নায়ক বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের নন। তিনি আফগানিস্তানের! যিনি বন্দিনী সিনেমায় অনবদ্য অভিনয় করে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ‘সাধের লাউ বানাল মোরে বৈরাগী’ শিরোনামে এই ছবির আরেকটি গান দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

আফগান নায়ক ওয়াহিদ কাদির বাংলা সিনেমায় এসেছিলেন ধূমকেতুর মত- আবার হারিয়েও যান একইভাবেই। বন্দিনী সিনেমার পর ওয়াহিদ আর অভিনয় করেননি। যদিও অভিনয় না করার কোন কারণ স্পষ্ট নয়।

১৯৫৪ সালে কাবুলে জন্ম নেওয়া ওয়াহিদ কাদির রাষ্ট্রদূত বাবার কল্যাণে ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সঙ্গে এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। পশতু, ইংরেজি, ফারসি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান ও হিন্দির পাশাপাশি বাংলা ভাষাও রপ্ত করেছিলেন তিনি।

১৯৮০ সালে ওয়াহিদ যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হন। সেখানে সিকিউরিটি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন। চাকরি শুরুর এক মাসের মধ্যেই এবিসি নেটওয়ার্কের জনপ্রিয় সিরিজ ‘জেনারেল হসপিটাল’-এ অভিনয়ের প্রস্তাব পান। সদ্য বিবাহিত এবং সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে নিরাপদ চাকরি ছেড়ে শোবিজে কাজ করাকে নিরাপদ মনে করেন নি ওয়াহিদ। ফলে অভিনয় করার ইচ্ছে চিরতরে মুছে যায় মন থেকে।

সিকিউরিটি কোম্পানির গার্ড হিসেবে নিজের শ্রম এবং মেধার সাক্ষর রাখেন ওয়াহিদ। ১১ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালে একটি সিকিউরিটি কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। পরে ১৯৯৭ সালে নিজেই শুরু করেন সিকিউরিটি বিজনেস। এরপর ইউএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসের সিইও হিসেবে বড় বড় কোম্পানিতে সার্ভিস দেওয়া শুরু করেন।

২০০১ সালে ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নামলে তীব্র আর্থিক সংকটে পড়েন ওয়াহিদ। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে যান। স্ত্রী ও তিন ছেলের সংসারের চালাতে হিমশিম খেতে থাকেন তিনি। এক সময় তার স্ত্রী রোনা আর বড় ছেলে ম্যাথিউ ক্লায়েন কাদের সংসার চালাতে চাকরি নেন। পরে ওয়াহিদ নিজেও আবার নতুন করে কোম্পানি শুরু করেন।

ওয়াহিদের দুঃসময়ে তার সম্ভ্রান্ত ও ধনাঢ্য পরিবার তার পাশে দাঁড়ায়নি। ২০০৩ সালে ওয়াহিদ কাদিরের মা আফগানিস্তানে তাদের পারিবারিক বিশাল সম্পত্তি তিন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে ছোট ছেলেকে ব্যবসার জন্য টাকা দেন। কিন্তু নির্মমভাবে বঞ্চিত করেন বড় ছেলে ওয়াহিদকে! এ ঘটনায় ওয়াহিদ ভীষণ মর্মাহত হন!

অর্থাভাবে ওয়াহিদ তার বিশাল সুইমিংপুলওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে ছোট্ট দু’রুমের এপার্টমেন্টে উঠেন। ক্রমশঃ বিষাদে ডুবতে থাকা ওয়াহিদ একসময় জীবনের কাছে হার মানেন। অসম্ভব অভিমান নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্দেশ্যে লিখে যান তার শেষ চিঠি- চিঠিতে তিনি লিখেন,

‘আমি কারো মাথাব্যথার কারণ হতে চাইনা। আমার দেহটি তোমরা পুড়িয়ে দিও! আমি অলরেডি দরদাম দেখে রেখেছি। মাত্র ৮০০ ডলার লাগবে! আমাকে কবর দিতে যেওনা, অনেক খরচের ব্যাপার। আমি তোমাদের আর কোন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইনা! আমার স্ত্রী আর তিন সন্তানকে আমি অনেক ভালোবাসি, কিন্তু আমার যাবার সময় হয়ে গেছে।’

জন্মদিনে ছেলের স্বপ্নের গাড়ি উপহার দেওয়া বাংলা চলচ্চিত্রের নায়ক ওয়াহিদ কাদের ২০০৪ সালের ২৮ নভেম্বর মাত্র ৫০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন। বাবার মৃত্যুর পর ছেলে ম্যাথিউ ক্লায়েন কাদের পরিবারের হাল ধরেন, তিল তিল করে আবারও গড়ে তোলেন নিজেদের কোম্পানি। মাত্র দশ বছরে তার পরিবার ঘুরে দাঁড়ায়। পেয়ে যায় অর্থনৈতিক সাফল্য।

ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন ওয়াহিদের মেঝো ছেলে ইয়ামা কাদের। ছোট ছেলে যোসেফ কাদের যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে কাজ করেন। স্ত্রী রোনা ছোট ছেলের সঙ্গেই থাকেন ক্যালিফোর্নিয়াতে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য সংবাদ