পদ্মা সেতু আমাদের অহঙ্কার বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, প্রমত্তা পদ্মা নদী দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরাই জানেন, কী ঝুঁকি নিয়ে আর কত কষ্ট এবং সময় ব্যয় করে রাজধানীতে পৌঁছতে হয়। তাদের কষ্ট লাঘবে আগামি ২৫শে জুন শনিবার বহুল আকাঙ্ক্ষিত এই পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হবে। আজ বুধবার (২২শে জুন) বেলা ১১টার দিকে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আমি ১৯৯৭ সালে জাপান সফর করি। পদ্মা নদী এবং রুপসা নদীর উপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব করি। জাপান সরকার দু’টি নদীর উপরই সেতু নির্মাণে রাজি হয়। যেহেতু পদ্মা অনেক খরস্রোতা, বিশাল নদী, তাই পদ্মা নদীর উপর সেতু সমীক্ষা শুরু করে। আর রূপসা নদীর উপর আমার অনুরোধে পূর্বেই নির্মাণ কাজ শুরু করে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালে পদ্মার নদীর উপর সেতু নির্মাণের সমীক্ষার তথ্য আমাদের দেয়। জাপানের সমীক্ষায় মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের স্থান নির্বাচন করা হয়। এই সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে আমি মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে আমরা সরকারে আসতে পারিনি। ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামাত জোট সরকার মাওয়া প্রান্তে সেতু নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং জাপান সরকারকে পুনরায় মানিকগঞ্জের আরিচা প্রান্তে পদ্মা সেতুর জন্য সমীক্ষা করতে বলে। দ্বিতীয়বার সমীক্ষার পর জাপান মাওয়া প্রান্তকেই নির্দিষ্ট করে পদ্মা সেতু নির্মাণের রিপোর্ট পেশ করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে আমরা আবার সরকারের দায়িত্বে এসে পদ্মা সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করি। সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার ২২ দিনের মাথায় পদ্মা সেতুর পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘মনসেল এইকম’কে নিয়োগ দেওয়া হয়। শুরুতে সেতু প্রকল্পে রেল চলাচলের সুবিধা ছিল না। আমি রেল সুবিধা যুক্ত করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নের নির্দেশ দেই।
২০১০ সালের মধ্যে নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়। পরের বছর জানুয়ারিতে ডিপিপি সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ব্যয় বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি কারণ ছিল। শুরুতে মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫ দশমিক পাঁচ-আট কিলোমিটার। পরে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক এক পাঁচ কিলোমিটার হয় বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সব ষড়যন্ত্র-প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি। মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে লাখো শুকরিয়া। আমি বাংলাদেশের মানুষকে ধন্যবাদ জানাতে চাই- তারা আমার পাশে ছিলেন। তাদের সহযোগিতার জন্যই আজ পদ্মা সেতু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংকের (আইডিবি) সঙ্গে ঋণচুক্তি সই করা হয়। এরপর শুরু হয় ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের পেছনে কে বা কারা ছিল তা আমি বহুবার বলেছি। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের জন্য দেশের মানুষের কেউ ক্ষতি করতে পারে এটা সত্যিই কল্পনার বাইরে ছিল।
‘এই ষড়যন্ত্রকারীরা ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরের একটি গ্রুপ ছিল যারা অন্যায্যভাবে কিছু কিছু বিষয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল’- বলেন তিনি।
সরকারপ্রধান বলেন, প্রাক-যোগ্য ঠিকাদার নির্বাচনের এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক, কারিগরি কমিটিকে একটি প্রাক-যোগ্য ঠিকাদারকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত থাকার কারণে বাদ দিতে বলে এবং একটি প্রাক-যোগ্যতায় অযোগ্য ঠিকাদারকে যোগ্য করতে বলে। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে কারিগরি কমিটি প্রাক-যোগ্য কোয়ালিফায়েড দরদাতাকে বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্তির কারণে বাদ দেয়। কিন্তু প্রাক-যোগ্যতা যাচাই-বাছাইয়ে অযোগ্য দরদাতাকে অভিজ্ঞতার জাল সার্টিফিকেট দেওয়ায় যোগ্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাংক এ প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য করার লক্ষ্যে তার অনুকূলে পরোক্ষ চাপ দিতে থাকে। এরপরই তারা পদ্মা সেতুর কার্যক্রমে বাধা দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের তিন সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান লুইস মোরেনো ওকাম্পোকে ঢাকায় পাঠায়। ওকাম্পো ঢাকায় এসে সরকারবিরোধী বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, তৎকালীন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া এবং যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে গ্রেফতার করার কথা বলেন।
‘২০১২ সালের ৯ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের এক বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিই। আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পদ্মা সেতুর জন্য অর্থ না নেওয়ার কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর দেশের এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদরা কীভাবে মনগড়া সমালোচনায় মেতে উঠেছিল, আপনারা দেখেছেন।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণকাজের গুণগত মানে কোনো আপস করা হয়নি। এ সেই নির্মিত হয়েছে বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে। পুরো নির্মাণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে। পদ্মা সেতুর পাইল বা মাটির গভীরে বসানো ভিত্তি এখন পর্যন্ত বিশ্বে গভীরতম। সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীর পর্যন্ত এ সেতুর পাইল বসানো হয়েছে। ভূমিকম্প প্রতিরোধ বিবেচনায় ব্যবহৃত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।