নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণমুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আরো আছে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন। তবু রক্ষা পাচ্ছে না নদীর দখল ও দূষণ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্প-কারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজপ্রাণী হুমকিতে পড়ছে, অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীকে এখনই রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে। এরই মধ্যে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। ওয়াটার কিপারসের সমীক্ষা বলছে, এসব নদীতীরবর্তী অধিবাসীদের ৫৭ শতাংশ বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছে।
ঢাকার চারপাশের চার নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর বালু। এই নদনদীগুলো ঢাকার প্রাণ। দূষণ-দখলের কবলে থেকে রাজধানীর কোলঘেঁষা নদীগুলোকে আর বাঁচানো যাচ্ছে না। প্রতিদিনই দূষণ বাড়ছে, বাড়ছে দখলদারদের সংখ্যা। রাজধানী ঢাকার পরিবেষ্টিত নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষার শতচেষ্টা বিফলে যাচ্ছে। শঙ্কার কথা, রাজধানীর কোলঘেঁষা এসব নদনদী না বাঁচানো গেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে, ঘটতে শুরুও করেছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগব্যাধিতে। এখনই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। প্রতিটি সরকারই আশ্বাস দিয়েছে অবৈধ দখলমুক্ত এবং নদীর দূষণ দূর করে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানোর, কিন্তু কেউ কথা রাখেনি। দূষিত হতে হতে পানি তার স্বাভাবিক ঘনত্বটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। এ কারণে অনেক নদীতে আগে থেকেই মাছ নেই। শীতলক্ষ্যা ও বালুতে মাছ ধরতে জেলেদের দেখা যায় না। মাছ থাকার মতো অবস্থা নেই। অথচ এ শীতলক্ষ্যায় ইলিশ পর্যন্ত মিলত। শীতলক্ষ্যার পানি দিয়ে একসময়কার বিখ্যাত সোডা ওয়াটার পর্যন্ত তৈরি হতো। বোতলের গায়ে লিখা থাকত মেড বাই শীতলক্ষ্যা ওয়াটার। নদীগুলো এখন বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। পলিথিন, ট্যানারিসহ শিল্প-কারখানা ও হাসপাতাল-ক্লিনিকের বিষাক্ত বর্জ্যে ভরপুর নদীর পানি।
নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে নগর, বন্দর, শহর, গ্রাম, জেলেপাড়া, বাণিজ্যকেন্দ্র প্রভৃতি। এ নদীকে ঘিরেই ছিল আদিকালের যাতায়াতের সব ব্যবস্থা। কৃষি, মত্স্য, জেলেদের পেশা এবং সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষের নিত্যদিনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক সম্পদ সবকিছুর একমাত্র উৎস ছিল নদী। কিন্তু সেই নদী আজ দখল, দূষণ আর ভরাটের প্রতিযোগিতায় বিপন্ন; অনেকাংশে বিলুপ্ত। সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে শহর-বন্দরের পয়োবর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য। বিষাক্ত সব রাসায়নিক এবং প্লাস্টিক ও পলিথিনের দূষণে নদীগুলো ভয়ংকর দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে। এতে নদীতীরবর্তী মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন পরিষেবার ঘাটতিতে স্থানীয় বাসিন্দারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। স্থানীয়দের নদীকেন্দ্রিক যে মিথস্ক্রিয়া ছিল, তা কমে গিয়েছে। তীরবর্তী মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাসে নদী দূষণ রোধ করতে হবে সর্বাগ্রে। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে নগরদারিদ্র নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনতে কাজ করছে। এটি সম্ভব কেবল তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে।
নগর দারিদ্র্য নিরসন বর্তমান সময়ে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে তাদের অন্তর্ভুক্তি নেই বললে চলে। তাদের জন্য নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পয়োনিষ্কাশন সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। আর এসব কাজের জন্য নগর দরিদ্ররা ব্যাপকভাবে নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদীর পানি দূষণের শিকার হওয়ায় সবচেয়ে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্ররা। নদীতীরবর্তী বাসিন্দাদের বেশির ভাগ সরকারি বা অন্যের পতিত জমিতে বসতি স্থাপন করে বাস করে। খুব কমসংখ্যক মানুষের নিজস্ব জমিতে বসতি রয়েছে। সরকারি জমিতে বসবাসরতরা সবসময়ই উচ্ছেদের ঝুঁকিতে থাকে। এসব পরিবার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে স্থাপিত নলকূপ ও ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) সরবরাহকৃত সীমিত পরিসরের পানির ওপর নির্ভরশীল। টঙ্গী খালের দক্ষিণ তীরে বসবাসকারীরা বৈধ বা অবৈধভাবে ওয়াসার পানি প্রাপ্তির সুবিধা পেলেও উত্তর পাড়ের বাসিন্দারা কমিউনিটিভিত্তিক নলকূপের ওপর নির্ভরশীল। হাঁটার দূরত্বে উন্নত পানির উৎস থাকলেও পানি নির্দিষ্ট সময় পাওয়া যায়। এ পানি পান করা বা রান্নার জন্য নিতে হলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। টঙ্গী খালপাড়ের বাসিন্দাদের ৬৮ শতাংশ ন্যূনতম পাঁচ পরিবার একই উৎস থেকে পানি সংগ্রহ করে। বাকিরা তারও বেশি পরিবার একসঙ্গে পানি সংগ্রহ করে। থালা-বাসন ও কাপড় ধোয়া, মাছ ও শাকসবজি পরিষ্কারের মাধ্যমে নদীর পানি সরাসরি ব্যবহার করে বাসিন্দারা। শুধু দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াসার পানির সরবরাহ থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য সময়ের কাজের জন্য তাদের নদীর ওপর নির্ভর করতে হয়। আগে সময় কাটাতে বা মনের আনন্দে নদীতে সাঁতার কাটার যে বিষয়টি ছিল সেটি এখন আর নেই। কারণ দূষণের কারণে ও পানির স্বল্পতায় নদীতে বেশির ভাগ সময় সাঁতার কাটার পরিস্থিতি থাকে না। ফলে স্থানীয়দের নদীকেন্দ্রিক যে মিথস্ক্রিয়া ছিল, তা কমে গিয়েছে।