দেশে সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের ৫০.২৭ শতাংশই বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে বলে সিসিএ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় উঠে এসেছে। তাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর। এ হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি।
শনিবার (১৩ আগস্ট) বেলা ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে প্রতিবেদনের বিস্তারিত তুলে ধরেন গবেষক দলের প্রধান ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সিনিয়র লেকচারার মনিরা নাজমীন জাহান। এসময় সাইবার অপরাধ কমিয়ে আনতে তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির অহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া আলোচকদের মধ্যে ছিলেন ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন আইএসপিএবির প্রেসিডেন্ট মো. ইমদাদুল হক, প্রযুক্তিবিদদের আন্তর্জাতিক সংগঠন আইসাকা ঢাকা চ্যাপ্টারের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার সুলতানা ইশরাত জাহান।
সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণা অনুযায়ী, ক্রমেই এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রপ্রচার বাড়তে শুরু করেছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, হয়রানির শিকারের পর ভুক্তভোগীদের মাত্র ২৬.৬ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে গেছে। এছাড়া আইনের আশ্রয় নেয়া ভুক্তভোগীদের মাত্র ৭.০৪ শতাংশ আশানুরূপ ফল পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। লোকলজ্জার ভয়সহ বিভিন্ন কারণে অপরাধের বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কোথাও অভিযোগ করেন না। সার্বিক পরিস্থিতিতে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ আটটি সুপারিশ তুলে ধরা হয় গবেষণা প্রতিবেদনে।
জরিপে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ০২ মার্চ পর্যন্ত ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগী ১৯৯ জনকে ১৮টি প্রশ্ন করা হয়। সেই মতামতের ভিত্তিতে এ বছরের গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট, সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার এবং অনলাইনে-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে মানসিক হয়রানি।
এবারের জরিপে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০.২৭ শতাংশ হয়েছে, যা গতবারের প্রতিবেদনে ছিল ৫০.১৬ শতাংশ। এ বছর দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং বা তথ্য চুরি। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করে অপপ্রচার চালানো এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
জরিপে সাইবার অপরাধের তুলনামূলক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রথম স্থানে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনা, যার হার ২৩.৭৯ শতাংশ। ২০২১ সালের প্রতিবেদনে এ হার ছিল ২৮.৩১ শতাংশ, যা এবারের তুলনায় ৪.৫২ শতাংশ বেশি। তবে চিন্তার বিষয়, গতবারের প্রতিবেদনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের ঘটনা ছিল ১৬.৩১ শতাংশ। কিন্তু এবার তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮.৬৭ শতাংশ, যা গতবারের তুলনায় ২.৩৬ শতাংশ বেশি।
এছাড়া যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ গতবার ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল। কিন্তু সেটা এবার বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে। ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা গতবারের প্রতিবেদনে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গিয়েছিল। এবার তা ১ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
করোনা মহামারীর কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষ অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যন্ত হয়ে যায়। ফলে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীর সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে গেছে। জরিপ অনুযায়ী, প্রায় ১৫ দশমিক ০৬ শতাংশ মানুষ অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতির আগের বছরগুলোর এবং পরের বছরের গবেষণা প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বোচ্চ সংঘটিত অপরাধগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়-উল্লেখযোগ্য হারে বিগত চার বছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপ্রপ্রচার কমেছে। তবে গত বছর এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ফটোশপে ছবি বিকৃতির ঘটনাও নতুন করে বাড়ছে। সবচেয়ে শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে অনলাইন কেনাকাটায়। ই-কমার্স খাতে চার বছরে ধারাবাহিক অপরাধ বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর এবং এ হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগী এবং এ ভুক্তভোগীদের হার ১৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৩১-৪৫ বছর বয়সের ভুক্তভোগী, যাদের হার ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ। সর্বশেষ অবস্থান করছে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের ভুক্তভোগী, যার হার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। ১৮-৩০ বছর এবং ১৮ এর চেয়ে কম বয়সের ভুক্তভোগীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইডি হ্যাকিং বা তথ্য চুরির মতো সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন বেশি।
আরেকটি আশঙ্কাজনক ব্যাপার হচ্ছে, ১৮ বছরের কম বয়সী ভুক্তভোগীদের বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় ৪.৬৪ শতাংশ বেশি এসেছে এবারের জরিপে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে পরিলক্ষিত হয়েছে, নারী ও পুরুষের মধ্য সাইবার অপরাধে আক্রান্ত হওয়ার মাত্রায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের তুলনায় নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার বেশি হয়েছেন।
সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডারভিত্তিক পার্থক্য করলে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্য পুরষের সংখ্যা ৪৩.২২ শতাংশ এবং নারীদের সংখ্যা ৫৬.৭৮ শতাংশ। এছাড়া পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হয়েছেন।
অন্যদিকে, নারীদের তুলনায় পুরুষরা মোবাইল ব্যাংকিং/এটিএম কার্ড হ্যাকিংয়ের শিকার বেশি হয়েছেন এবং অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন ৪৩.২২ শতাংশ। বাকি ৫৬.৭৮ শতাংশ ভুক্তভোগীর দেশে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। গতবছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায, ভুক্তভোগীদের মধ্যে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২১.০৭ শতাংশ কম ভুক্তভোগী তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইন সম্পর্কে জানেন।
আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রবণতা কম। ১৯৯ ভুক্তভোগীর মধ্যে মাত্র ৫৩ জন সমস্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অভিযোগ করেছেন। এটা মোট ভুক্তভোগীর মাত্র ২৬.৬ শতাংশ, যা ২০২১ এর পরিসংখানের তুলনায় ৫.১৭ শতাংশ বেশি। সমস্যা নিয়ে পুরুষ অভিযোগকারীর ১৫.৫৮ শতাংশ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন এবং ২৭.৬৪ শতাংশ হননি।
পরিসংখ্যানে লক্ষ্যণীয়, পুরুষ অভিযোগকারীদের তুলনাই নারী অভিযোগকারীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। নারী ভুক্তভোগীদের মধ্যে মাত্র ১১.০৬ শতাংশ সমস্যা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়েছেন এবং ৪৫.৭৩ শতাংশ আইনের আশ্রয় নিতে অনিহা প্রকাশ করেছেন।
গবেষণা অনুযায়ী, অভিযোগকারীদের মধ্যে মাত্র ৭.০৪ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হয়ে আশানুরূপ ফল পেয়েছেন এবং ৫৫.২৭ শতাংশ ভুক্তভোগী অভিযোগের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পাননি। অভিযোগের পর প্রত্যাশিত ফল পাওয়ায় পুরুষ এবং নারীভেদে ভিন্নতা রয়েছে। অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পাওয়ার ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষের সংখ্যা ৮ জন বা ৪.০২ শতাংশ, সেখানে নারীর সংখ্যা মাত্র ৬ জন বা ৩.০২শতাংশ। অন্যদিকে, আশানুরূপ ফল না পাওয়া নারীদের সংখ্যা ২৮.৬৪ শতাংশ, যেদিকে পুরুষের সংখ্যা ২৬.৬৩ শতাংশ।
২০২১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিযোগের পর আশানুরূপ ফল পেয়েছেন মোট ভুক্তভোগীর ২২.২২ শতাংশ, যা ২০২২ সালের পরিসংখ্যানের তুলনায় ১৫.১৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ, এবারের প্রতিবেদনে প্রতাশিত ফল পাওয়ার পরিমাণ অনেকাংশে কমেছে।
প্রাপ্ত উপাত্তগুলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভুক্তভোগীদের আইনি ব্যবস্থা না নেয়ার কারণের মধ্যে ভিন্নতা দেখা গেছে। বিষয়টিকে গোপন রাখতে আইনি ব্যবস্থা নেয়নি সর্বোচ্চ ২১ শতাংশ ভুক্তভোগী।
এছাড়া ১৭ শতাংশ ভুক্তভোগী সামাজিক ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য, ১৭ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিয়ে উল্টো হয়রানি পোহাতে হবে, ১৭ শতাংশ অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না ভেবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী। অন্যদিকে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন আছে তা মনেই করেননি।
ব্যাপকভাবে সাইবার সচেতনতামূলক কার্যক্রম, জাতীয় বাজেটে সাইবার সচেতনতায় গুরুত্ব দেয়া, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআরে সাইবার সচেতনতা বাধ্যতামূলক করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাইবার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা, সাইবার স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি, সচেতনতামূলক কাজে রাজনৈতিক জনশক্তির সঠিক ব্যবহার, গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার এবং অংশীজনদের সম্মলিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলে সুস্থ সাইবার সংস্কৃতি গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।