দেশে মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। গত কয়েক সপ্তাহে সারাদেশে এ ভাইরাসের প্রকোপ বেড়েছে। প্রতিদিন উদ্বেগজনকভাবে লাফিয়ে বাড়ছে শনাক্ত আর মৃত্যু সংখ্যা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে সরকার দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে। ফলে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে মানুষ। কিন্তু নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। একদিকে সংক্রমণ ঝুঁকির কারণে লকডাইনে ঘরবন্দি মানুষের ঘরে খাবার নেই অন্যদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে বন্যার শঙ্কা। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও নদীপারের মানুষের জন্য মহামারির পাশাপাশি এখন আসন্ন বন্যা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই এ অঞ্চেলের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি জীবন কাটাচ্ছে। এমনিতেই লকডাউনের কারণে উত্তরাঞ্চলে এবার আমের ব্যবসা মন্দা গেছে। এরপর বন্যার হানায় দিশাহারা হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের মানুষ। নেই সরকারের কোনো ত্রাণ সহায়তাও। আগাম বন্যার শঙ্কা যেন স্বপ্নের রাজপ্রাসাদে দৈত্যের হানা। সংকট মোকাবিলায় বা পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ এখন পানিবন্দি মানুষের চোখে ধূসর ছায়া। জীবিকার সন্ধানে বের হওয়া দুর্বিষহ জীবনে আগামীর পথ চলায় মহামারির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যা। জীবন এখন পরিবার-পরিজনের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দিতে বান আর চোখের পানিতে ভেলায় ভাসছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে বিভিন্ন নদীর পানি। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও পদ্মা অববাহিকায় উজান থেকে আসা পানি বাড়ছে দ্রুত। অন্তত ২০টি জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে গেলেই সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, বগুড়া ও জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র (এফএফডব্লিউসি)। সূত্রটি বলছে, বরাবরের মতো এবারও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় বন্যা বিস্তৃত আকার নিতে পারে। ফলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের নিচু এলাকায় বন্যা দেখা দিতে পারে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের গাণিতিক মডেলের তথ্যানুযায়ী, আগামী বুধবার থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার নানা জায়গায় ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এ সময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকা ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য অববাহিকার প্রধান নদীগুলোর পানি দ্রুত বেড়ে কয়েকটি স্থানে আকস্মিক বন্যা দেখা দিতে পারে। আর এফএফডব্লিউসি’র বুলেটিনে বলা হয়, বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি স্থিতিশীল থাকলেও আগামী ২৪ ঘণ্টায় সমতলে পানি বাড়তে পারে। গঙ্গার পানি কমলেও পদ্মার পানি বাড়ছে। যা ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকবে। তবে আপার মেঘনার পানি স্থিতিশীল আছে।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাব এবং উজানে ভারি বৃষ্টির কারণে দেশের নদনদীগুলোর পানি বাড়ছে। নদী অববাহিকার বহু এলাকা এখন আস্তে আস্তে প্লাবিত হচ্ছে। আগামী ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীর পানি দ্রুত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে একটি স্বল্পমেয়াদি বন্যা শুরু হতে পারে। এটি দশ থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এবং উজানে ভারি বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা আশঙ্কা করছি, আগামী দুই-চার দিনের মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট অঞ্চলগুলোতে বন্যার ঝুঁকি আছে। পরে এই বন্যা দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চল সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া হয়ে মধ্যাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হতে পারে। সেক্ষেত্রে আগামী সপ্তাহের মধ্যে দেশের মধ্যাঞ্চলের রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর বন্যাকবলিত হবার শঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযায়ী জুলাই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কথা বলা হয়েছে। তবে চলতি মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি। এটি দেশের ভেতরে এবং উজানেও বেশি। সেক্ষেত্রে আমরা আশঙ্কা করছি মধ্যমানের একটি বন্যা হতে পারে।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদনদীগুলোর পানির সমতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। একইভাবে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার পানির সমতল বাড়তে শুরু করেছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। এ ছাড়া গঙ্গা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে ও পদ্মা নদীর পানির সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ৭২ ঘণ্টা দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও ভারতের হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, মেঘালয়সহ আশেপাশের এলাকায় ভারি বৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার নদীগুলোর পানির সমতল সময়বিশেষে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
পাশাপাশি যমুনার অব্যাহত ভাঙনে পাল্টে গেছে টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার সলিমাবাদ ইউনিয়নের খাষ ঘুণি পাড়া ও খাষ তেবাড়িয়া গ্রামের মানচিত্র। চারপাশে এখন শুধু পানি আর পানি। এখানে ছিল ফসলের মাঠ, বসতবাড়ি, খেলার মাঠ, মসজিদ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব কিছু বিলীন হয়ে গেছে যমুনার ভাঙনে। ফলে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নদীতীরবর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনকে সতর্ক থাকতে বলেছে সরকার। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে এরই মধ্যে নগদ টাকা ও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে প্রশাসকদের সঙ্গে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সমন্বয় করে কাজ করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের সঙ্গে। এ কার্যালয়গুলোর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাখা হয়েছে ‘স্ট্যান্ডবাই’। অর্থাৎ জরুরি প্রয়োজনে যেন মুহূর্তে যে-কাউকে কাজে লাগানো যায়।
এ প্রসঙ্গে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান বলেন, এই মুহূর্তে বড় কোনো ঝুঁকি নেই। তবে আমরা প্রস্তুতি রেখেছি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি। বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। জরুরি খাদ্য সরবরাহে পর্যাপ্ত টাকা ও খাদ্যসামগ্রী জেলা প্রশাসকদের কাছে দেওয়া আছে। তিনি বলেন, ডিসিদের তৈরি থাকতে বলেছি। বন্যায় যাতে গবাদিপশু বিশেষ করে কোরবানির পশুর কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখার অনুরোধ করেছি।
সূত্র: জবাবদিহি