শিশুদের কাছে মোবাইল, ট্যাবের মতো গেজেটগুলো খুবই প্রিয়। এগুলো পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায় তারা। খাওয়ার সময়ও তাকিয়ে থাকে মোবাইলের স্ক্রিনে। এই সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার।
‘আমি ভুল করেছি, আমি অপরাধী। আমি মোবাইল ছাড়া খেতে চাই না। কিন্তু খেতে চাইনি বলে কেউ গল্প করে, আদর করে খাওয়ায়নি তো! আমাকে মোবাইল দিয়ে ভুলিয়েছে। আমিও ভুলেছি। এখন মোবাইল ছাড়া খেতে ইচ্ছে করে না।’ টেলিভিশন বিজ্ঞাপনে এক শিশুর আদালতে দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে বলা কথাগুলো হূদয় ছুঁয়ে যায় দর্শকদের। এরপরই যেন বোধোদয় ঘটে শিশুটির মা-বাবার। বিজ্ঞাপনের মা-বাবা ও শিশুর ঘটনাগুলো বাস্তবে দিন দিন বাড়ছেই। শিশুর মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে, শিশুকে ভুলিয়ে রাখতে অনায়াসে তার হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে মা-বাবারা। এর ফল হচ্ছে বিরূপ। ক্ষণিকের স্বস্তি ও সময় বাঁচানোর জন্য মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে নতুন প্রজন্মের শিশুরা। পড়াশোনা, খেলাধুলা, গল্প করা বাদ দিয়ে সারা দিন পড়ে থাকছে মোবাইল নিয়েই। এতে স্থূল হয়ে যাওয়া, সঠিক সময়ে কথা না শেখা, চুপচাপ থাকাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যায় ভুগছে শিশুরা। অভিভাবকদের যখন বোধোদয় ঘটছে তত দিনে দেরি হয়ে গেছে অনেক। আবার এ জন্য উল্টো শিশুকেই দোষারোপ করা হচ্ছে সবার সামনে—ও মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু খেতে চায় না। সারা দিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে।
মোবাইল দেখে দেখে খাওয়া একটা সমস্যা। এতে শিশু মোবাইলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। আবার খাওয়ার সময় সে কী খাচ্ছে তার সঙ্গেও তার যোগাযোগ থাকে না। মোবাইল দেখে খাওয়ার সময় শিশুর মনোযোগ দুই দিকে ভাগ হয়ে যায়। কম্পানিগুলো তাদের ব্যাবসায়িক সুবিধার জন্য নিত্যনতুন ফিচার যোগ করে মোবাইলে। এতে এর ভোক্তা দিন দিন বাড়ে। এ জন্য সে শিশু হোক কিংবা বড়—বেশি ব্যবহার করলে আসক্তি তৈরি হবেই।
শিশু জন্ম হওয়ার পর থেকেই নানাভাবে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। চারপাশের নানা কিছু পর্যবেক্ষণ ও দেখার মধ্য দিয়ে শিশুর মানসিক উন্নতি সাধন হয়। কিন্তু শিশু যখন মোবাইল দেখে খাচ্ছে, তখন সে বাইরের জগত্ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। টানা এ রকম চলতে থাকলে একসময় তার মধ্যে মোবাইল আসক্তি তৈরি হবে। মোবাইলের প্রতি নির্ভরশীলতা তৈরি হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মধ্যে আরো নিত্যনতুন কৌতূহল তৈরি হবে মোবাইল নিয়ে। এই সময় অন্যদের সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা, খেলাধুলা, সামাজিক মেলামেশার মতো বিষয়গুলো তার মধ্যে তৈরি না-ও হতে পারে। একসময় দেখা যায়, শিশুরা মোবাইল ছাড়া একমুহূর্ত থাকতে পারে না। পড়াশোনা থেকে শুরু করে নানা বিষয় নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়। কারণ শিশুরা খেলতে খেলতে অনেক কিছু শেখে। যেটা তাদের মধ্যে ভবিষ্যত্ জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাহায্য করে। মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকায় সেই দক্ষতাটুকু আর তাদের মধ্যে তৈরি হয় না।
মোবাইল দিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর সময় শুধু খাওয়ার প্রতি আগ্রহই নষ্ট করছি না, বাইরের জগতের সঙ্গে তার যে যোগাযোগ ও সামাজিক দক্ষতা তৈরি হতো তা থেকেও তাকে বঞ্চিত করছি আমরা। মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে, খাওয়া কিন্তু এক ধরনের আনন্দদায়ক ব্যাপার। বিভিন্ন খাবারের স্বাদ, গন্ধ ও আকার-আকৃতির মধ্যেও শেখার, জানার ও বোঝার নানা কিছু রয়েছে। মোবাইল দেখে খাওয়ার সময় এসব কিছু থেকে বঞ্চিত হয় শিশু।
এতে খাওয়ার প্রতি শিশুর আগ্রহ তৈরি হয় না। খাওয়াকে সে একটা দায়িত্ব হিসেবে দেখে। আবার খাবারের পুষ্টিগত প্রভাবের সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক রয়েছে। আমরা কী খাচ্ছি, তা যদি জেনে-বুঝে না খাই তাহলে সেই পুষ্টিগত প্রভাব থেকে বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য মোবাইল দিয়ে শিশুকে এখন থেকেই খাবার খাওয়ানোর
চর্চা বাদ দিন।
এই মুহূর্তে হয়তো আপনি শিশুকে যেকোনোভাবে খাইয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছেন; কিন্তু এর যে মানসিক কুপ্রভাব তার ফল সুদূরপ্রসারী।
সূত্র : কালের কণ্ঠ