শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:২৩ পূর্বাহ্ন

করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখি : দেশে নতুন ধরন তৈরির শঙ্কা রয়েছে

খালেদ মাহমুদ রকি
আপডেট : আগস্ট ২৬, ২০২১

# টিকাদান নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রসার ঘটানো জরুরি # স্বাস্থ্যবিধি না মানলে ফের সংক্রমণ বাড়বে
# সংক্রমণ হার ৫ শতাংশে না নামলে আত্মতুষ্টির কিছু নেই

মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর চলতি বছরের মার্চের শেষ দিকে ফের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রথম দিক থেকে সংক্রমণ কম থাকলেও দেশে ডেল্টা ধরন আসার পর পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ নিতে থাকে। ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর করোনা ভাইরাসের একটি করে মিউটেশন (রূপান্তর) হয়ে থাকে। রূপান্তর হয়ে যে ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) তৈরি করে তা সবসময় টিকে থাকে না।

ফলে মিউটেশন হলেও তা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয় না। মিউটেশনের পর যে ভ্যারিয়েন্টটা হয়ে থাকে তা বিরাজমান ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রমণ ক্ষমতার অধিকারী হলেই নতুন ধরন শক্তিশালী হয়ে থাকে; যেমন ডেল্টা ধরন। বাংলাদেশেও যদি ডেল্টার মত কোনো শক্তিশালী ধরন তৈরি না তাহলে শঙ্কার কারন নেই। তবে এখন যেমন সংক্রমণ নিম্নগামী হচ্ছে প্রথম ঢেউয়ের শেষ দিকেও এমনটা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আবার ঊর্ধ্বমুখী হয় দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়। এবারও তেমনটা হতে পারে। তবে হয়তো খুব শিগগিরই না। এ কারণে সময় থাকতেই প্রয়োজন তৃতীয় ঢেউয়ের আগাম প্রস্তুতি নেয়া। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রসার ঘটনোর পাশপাশি টিকাদান নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং ব্যক্তি সচেতনাতার বিকল্প দেখছেন না স্বাস্থ্যবিদরা।

দেশে করোনা সংক্রমণের পর মৃত্যু ও শনাক্তের দিক থেকে ভয়াবহ মাস ছিলো জুলাই। তবে চলতি আগস্টের মাঝামাঝি তা কমতে শুরু করে। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারে নিম্ন্নমুখী প্রবণতার পাশাপাশি মৃত্যুও কমছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জুনের শেষ দিক থেকে পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের বেশি। ১৬ আগস্ট পর্যন্ত তা ২০-এর ওপরেই ছিল। এর মধ্যে বেশ কিছুদিন শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের বেশি ছিল। কিন্তু গতকাল বুধবার রোগী শনাক্তের হার ১৫ শতাংশের মধ্যেই ছিল।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ঈদের আগেপরে আরোপ করা কঠোর বিধিনিষেধের ফলে আগস্টের প্রথম দিক থেকে সংক্রমণ নিম্নমুখী হচ্ছে। নতুন রোগী কমার পাশাপাশি মৃত্যুও কমছে। তাছাড়া টিকার প্রভাবও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। তবে শঙ্কা কিছুতেই কাটছে না। কারণ যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে রাস্তাঘাটে মানুষের ভিড় বাড়ছে, তাতে যে কোনো সময় আবার সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমবে। জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারিতে তা আরো কমবে। এর কারণ যে সময়টার কথা বলছি তখন আমাদের দেশে শীতকাল। এই সময় ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্যারা ইনফ্লুয়েঞ্জা থ্রি, রেসপিরেটরি সিনসিডিয়াল ভাইরাস এবং রায়নো ভাইরাস সংক্রমণ দেখা যায়। এসব ভাইরাসের কারণে মানুষের সর্দি-কাশি-জ্বর হয়ে থাকে। যখন এই চারটি ভাইরাসের একটি কারো শরীরে প্রবেশ করে তখন অন্য একটি ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে না।

 

যদিও অন্য কোনো ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে তাও প্রকাশ পায় না। এসব কারণে দেশে করোনার সংক্রমণ কমবে। গত বছরের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। কী করণে সংক্রমণ কমছে তা গবেষণা করে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে আমি মনে করি, আমাদের এখনই আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। অসাবধান হলেই ফের সংক্রমণ বাড়তে পারে। এছাড়া আমাদের অবশ্যই তৃতীয় ঢেউ কী ভাবে মোকাবেলা করব তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রসার ঘটাতে হবে। ঢাকাসহ সারাদেশে হাসপার্তালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন ব্যবস্থা ও রোগীর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপশি টিকাদান কর্মসূচি অব্যহত রাখা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং ব্যক্তি সচেতনার বিকল্প নেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর করোনা ভাইরাসের একটি করে মিউটেশন (রূপান্তর) হয়ে থাকে। রূপান্তর হয়ে যে ধরন তৈরি করে তা সবসময় টিকে থাকে না। ফলে মিউটেশন হলেও তা মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয় না। মিউটেশনের পর যে ধরনটা হয়ে থাকে তা বিরাজমান ধরনের চেয়ে বেশি সংক্রমণ ক্ষমতার অধিকারী হলেই নতুন ধরন প্রবল হয়ে থাকে; যেমন ডেল্টা ধরন। নতুন আরেকটি ধরনের জন্ম হলে পুরনোটার চেয়ে তা আরো বেশি সংক্রমণ ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়। বাংলাদেশে ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ শুরুর আগেই দক্ষিণ আফ্রিকান ধরন ও ইউকে ধরনের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সেগুলোর সংক্রমণ ক্ষমতা ডেল্টার চেয়ে বেশি না হওয়ায় ওই দুই ধরন বাংলাদেশে প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমনকি যুক্তরাজ্যে ইউকে’র আলফা ধরনের উদ্ভব হলেও বর্তমানে আলফার তেমন অস্তিত্ব নেই, অথচ ডেল্টা ধরন বেশ প্রবল ক্ষমতায় সংক্রমণ ঘটিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যেহেতু এখন পর্যন্ত নতুন কোনো ধরন উদ্ভব হয়নি, তাই ডেল্টা ধরন তার সংক্রমণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। তবে নতুন কোনো ধরন তৈরি হলে শঙ্কা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং (জিন নকশা বের করা) অণুজীব বিজ্ঞানী চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) নির্বাহী পরিচালক ডা. সমীর কুমার সাহা বলেন, করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট না হলে ডেল্টা নিয়ে নতুন করে ভয়ের কিছু নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে করোনা রোগী কম শনাক্তের ক্ষেত্রে কতগুলো কারণ আছে। করোনা প্রতিরোধে টিকাদান কার্যক্রম চলছে। এছাড়া আংশিক হলেও বিধিনিষেধের প্রভাব রয়েছে। বিজ্ঞান বলে সামাজিক সংক্রমণ যদি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত থাকে তাহলে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরক্ষা তৈরি হয়। শনাক্তের হার ও দৈনিক মৃতের সংখ্যা কমলেও দৈনিক মৃত্যুর যে হার তা কিন্তু এখনো অনেক বেশি। ১ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি। যা উদ্বেগের।

সংক্রমণ ও শনাক্ত রোগী কমতির ধারা দেখে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো কারণ নেই বলে মনে করেন বিশিষ্ট এই চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি বলেন, মৃত্যুর এই হার প্রমাণ করে দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতার দিকে আমাদের আরো বেশি নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। সর্বশেষ সংক্রমণের নিম্নগামীধারা অব্যাহত রাখতে টিকাদান কার্যক্রমের যেমন বিকল্প নেই তেমনি স্বাস্থ্যবিধি মানারও বিকল্প নেই।

 


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্যান্য সংবাদ