বাংলাদেশের বুক চিরে ছোট বড় প্রায় ৭শ’টির মতো নদনদী বয়ে গেছে। এ নদীগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান নদী হচ্ছে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি। নদীগুলো এ দেশের মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষের জীবনজীবিকা নদী পথের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে। এসব নদী যাতায়াত ও পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের জীবনকে সহজ ও গতিশীল করে তুলেছে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর এই নদনদীগুলো কৃষি কাজের সেচের একটি প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে। দেশে মানুষের মাছের চাহিদার একটা বিরাট অংশ এই নদীগুলো থেকে আসে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর এসব নদনদীর গুরুত্ব ও প্রভাব অপরিসীম। তারপরেও আমরা নদী ভরাট, কলকারখানার বর্জ্য, জাহাজের তেল, নগরের ময়লা আবর্জনা ইত্যাদি নদীতে ফেলে নদীকে দূষিত করছি।
নদী মানব সমাজের জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নদী একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পানির উৎস হিসেবে কাজ করে। আমরা নদী থেকে বিপুল পরিমাণ মিঠা পানি পেয়ে থাকি। ওই মিঠা পানিতে প্রচুর পরিমাণ মাছ পাওয়া যায়- যা আমাদের দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করে। শুধু আমাদের দেশের মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে এমন নয়। আমাদের দেশের নদীর মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বিদেশে মাছ রপ্তানির মাধ্যমে আমাদের দেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে কৃষি কাজ করেন। প্রবাহমান নদীগুলোর পানি আমাদের দেশের কৃষকরা সেচের পানি হিসেবে ব্যবহার করে। বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক এলাকায় এখনো সেচ পাম্প স্থাপন সম্ভব হয়নি। ওই অঞ্চলের মানুষ নদী থেকে তাদের কৃষি জমিতে সেচ দিয়ে থাকে। বন্যার সময় নদী উপকূলীয় অঞ্চলে প্রচুর পলিমাটি জমে। পলিমাটি জমার কারণে ওই জায়গার মাটি অনেক উর্বর হয়ে থাকে। ওই উর্বর মাটিতে চাষ করা হলে বেশ বাম্পার ফলন পাওয়া যায়। বাণিজ্যিক ও পরিবহণ কাজেও নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী প্রাচীন কাল থেকেই একটি পরিবহণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে এবং এখনো অনেক জায়গায় নদী যানবাহনের জনপ্রিয়তায় প্রসারিত রয়েছে। বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি জুড়ে রয়েছে নদনদীর সীমাহীন প্রভাব। এ দেশের গল্প-উপন্যাস, কবিতা আর গানের এক বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে নদনদী। নদীবিধৌত অঞ্চলকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও সারিগান- যা আমাদের সংস্কৃতির এক অনন্য অনুষঙ্গ। নদী আমাদের জীবনে আরও নানা রকম প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। কিন্তু নদী আমাদের এত প্রয়োজন হওয়া সত্ত্বেও আমরা মানুষ নদী রক্ষা না করে আরও নানাভাবে নদীকে দখল আর দূষণ করে ধ্বংস করছি।
বেসরকারি সংস্থা আরডিআরসি নদী নিয়ে গবেষণা করে থাকে এবং এই গবেষণাটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জরিপের জন্য নদীগুলো তারা বেছে নিয়েছিল।
সংস্থাটি গাজীপুরের একটি গবেষণাগারে প্রতিটি নদীর পানির পিএইচ লেভেল, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্যামিকেল অক্সিজেন ডিমান্ড (সিওডি) এবং বায়োলজিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড (বিওডি) পরীক্ষা করে।
যেকোনো মিশ্রনে অক্সিজেনের পরিমাপ হয় সিওডি দিয়ে। রাসায়নিকভাবে কোনো জৈব পদার্থকে পুরোপুরি জারিত বা অক্সিডাইজড করতে প্রতি লিটার পানিতে ২০০ মিলিগ্রাম অক্সিজেন দ্রবীভূত থাকতে হয়। আর বিওডি হলো কোনো মিশ্রণে ব্যাক্টেরিয়াসহ বিভিন্ন অনুজীবের অক্সিজেন চাহিদা, যা প্রতি লিটারে ৫০মিলিগ্রাম। পিএইচ হল মিশ্রনের অম্লতা কতটা তার পরিমাপ, পানির ক্ষেত্রে যা আদর্শভাবে ৬-৯ এর মধ্যে থাকা উচিত।
আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজাজ বলেন, ‘আমরা সাধারণ ধারণা দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী হলো বুড়িগঙ্গা। তবে আমরা জরিপে দেখেছি ঢাকা বিভাগেই বুড়িগঙ্গার চেয়েও দূষিত নদী আরও আছে’।
‘আমরা আরও যা দেখেছি ৫৬টি নদীর সবগুলোতেই প্লাস্টিক এবং পলিথিন দূষণ রয়েছে, যা সত্যিই উদ্বেগের,’ বলেন তিনি।
গবেষণার ৫৬টি নদীর ১৯টি ঢাকা বিভাগের যার সবগুলোই মারাত্মক দূষণের শিকার।
এছাড়াও জরিপে খুলনার ৭টি, সিলেটের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮টি, রাজশাহীর ২টি, বরিশালের ১১টি ও রংপুরের ৪টি নদীর দূষণমাত্রা দেখা হয়।