চৌদ্দ বছরের মেয়েটি বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে রাজধানীর মগবাজারে। কাজ করে একটি পোশাক কারখানায়। মালা নামে এক প্রতিবেশীর সঙ্গে টেইলার্সে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল একদিন। মালা তাকে কৌশলে নিয়ে যায় মালিবাগের আবুল হোটেলের পেছনে। তুলে দেয় কয়েকজন যুবকের হাতে। অজ্ঞাত সেই ব্যক্তিরা মেয়েটিকে অজ্ঞান করে নিয়ে যায় ধামরাইয়ে। সেখানে ২০ দিনেরও বেশি সময় আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয় তাকে। একপর্যায়ে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ছেড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটি ঘটেছিল গত বছরের ডিসেম্বরে। দীর্ঘ প্রায় ছয় মাস পর অপহরণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষক চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবির তেজগাঁও বিভাগের একটি দল।
গ্রেফতারকৃত দুই অপহরণকারী ও ধর্ষক হলো—নাজমুল ও জাহিদ। সম্প্রতি এই দুই ধর্ষককে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা সবকিছু স্বীকার করে। রিমান্ড শেষে ইতোমধ্যে দুই আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এই চক্রে থাকা আরও কয়েকজন দুর্বৃত্তকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
মেয়েটির বড় বোন জানান, নিখোঁজ থাকার পর আমরা অনেক খোঁজাখুজি করি। প্রায় ২০ দিন পর একদিন ছোট বোন তাকে সাভার নবীনগর থেকে ফোন করে। তারপর তারা তাকে উদ্ধার করেন। এ সময় তার বোন বিদ্ধস্ত অবস্থায় ছিলেন। ছোট বোনের শরীর দিয়ে রক্ত ঝড়ছিল। তাকে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টারে নিয়ে যান তারা। সেখানে আট দিন ধরে চিকিৎসা চলে তার। পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে থানায় গিয়ে মামলা করেন স্বজনরা।
মেয়েটির বড় বোন বলেন, ‘আমরা থানায় গিয়ে পুরো ঘটনা জানিয়েছি। কিন্তু থানা পুলিশ একটা অপহরণ মামলা নিয়েছে। আমরা অশিক্ষিত, গরিব মানুষ। মামলার এজাহার পুলিশ লিখে দিয়েছিল। সেখানে ধর্ষণের কথা লেখা হয়নি। দুই জন আসামির নাম দিলেও পুলিশ শুধু মালারে ধরছে। নাজমুলরে ধরেনি। মামলার পর আসামিরা টাকার মাধ্যমে আমাদের আপসের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু আমরা আপস করিনি। আমি বলছি, আমার বোনের সঙ্গে এত খারাপ একটা কাজ হইলো, আমরা এর বিচার চাই।’
পুলিশ জানিয়েছে, এ বছরের ১৩ জানুয়ারি শাহনাজ বেগম নামে এক নারী তার মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে বলে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। শাহনাজ বেগম মামলায় অভিযোগ করেন, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর তার মেয়েকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের পর হঠাৎ একটি নাম্বার থেকে তার মোবাইলে কল করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর তারা থানায় গিয়ে অভিযোগ করেন। মামলা হওয়ার পরদিনই মেয়েটিকে ছেড়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সাভার এলাকা থেকে মেয়েটি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে পরিবারের সদস্যরা তাকে গিয়ে নিয়ে আসেন। ওই দিনই পুলিশ তাকে আদালতে নিলে মুখ্য মহানগর হাকিম নিভানা খায়ের জেসী ২২ ধারায় মেয়েটির জবানবন্দি গ্রহণ করেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে মেয়েটি বলেছে, গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর দুপুর দেড়টার দিকে প্রতিবেশী মালা আক্তারে সঙ্গে তিনি একটি টেইলার্সের দোকানে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। কিছুদূর যাওয়ার পর মালা তাকে আবুল হোটেলের উল্টোপাশে ফুটওভার ব্রিজের নিচে নিয়ে যায়। সেখানে সিএনজি নিয়ে একটি লোক আসে। মালা তাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে ওই লোকটির সঙ্গে কথা বলে। এ সময় একজন লোক মেয়েটিকে পেছন থেকে স্প্রে জাতীয় কিছু মুখে দিলে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে যায়।
মেয়েটি জবানবন্দিতে বলেছে, ‘আমার যখন জ্ঞান ফেরে তখন নিজেকে একটি অন্ধকার ঘরে দেখতে পাই। রুমে একজন লোক ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, মালা আমাকে তার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমি বাসায় যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করলে সে আমাকে অনেক মারধর করে। ওই বাসায় লোকটি আমাকে আটকে রেখে অনেক মারধর করে এবং জোর করে একাধিকবার ধর্ষণ করে।’
জবানবন্দিতে কিশোরী মেয়েটি বলে, ‘ওই রুমে আটকে রাখার সাত দিন পর মালার ভাই নাজমুল আসে এবং মারধর করে আমার বক্তব্য রেকর্ড করায় যে, আমি ইচ্ছাকৃতভাবে বাসা থেকে চলে গিয়েছি এবং কুমিল্লার একটি ছেলেকে বিয়ে করেছি। আমি বাসায় যেতে চাইলে নাজমুল ও ওই লোকটি বলে, যদি আমি বাসা থেকে বিকাশে ৫০ হাজার টাকা এনে দিই, তাহলে আমাকে ছেড়ে দেবে।’
মেয়েটি বলেছে, ‘আমি তাদের অনেক অনুরোধ করেছি ছেড়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু তারা আমাকে ছাড়েনি। ওই রুমে আটক থাকা অবস্থায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোকজন এসে আমাকে ধর্ষণ করতো। পরে একদিন কয়েকজন লোক রুমে এসে আমাকে গোসল করায়ে চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠায়ে সাভারের নবীনগরে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে স্থানীয় লোকজনের সহযোগীতায় আমার বোনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাসায় আসি।’
মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর মেয়েটির ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি কিশোরী মেয়েটির সঙ্গে ‘ফোর্সফুল সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স’ হয়েছিল বলে একটি প্রতিবেদন দেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক মনিকা খন্দকার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, মামলাটি প্রথমে থানা পুলিশ তদন্ত করার পর সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা নথিপত্র ঘেঁটে দেখতে পান থানা পুলিশ আসামি মালাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। তারা মালাকে রিমান্ডে আনার আবেদন করলেও আদালত জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয়। জেলগেটের জিজ্ঞাসাবাদে মালা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এড়িয়ে যায়। পরে তারা প্রযুক্তির সহায়তায় নাজমুল ও জাহিদকে গ্রেফতার করে।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, মালা হলো এই ঘটনার মূল হোতা। জাহিদের সঙ্গে তার আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। অর্থের বিনিময়ে মালা ওই মেয়েটিকে জাহিদের হাতে তুলে দেয়। জাহিদ কৌশলে কয়েকজন সঙ্গীসহ মালিবাগ থেকে মেয়েটিকে অজ্ঞান করে ধামরাইয়ে নিয়ে এক বাসায় আটকে রাখে। সেখানে জাহিদসহ আরও কয়েকজন মিলে তাকে দলবেঁধে ধর্ষণ করে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শাহাদাত হোসেন সুমা বলেন, ‘আমরা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর দুই জনকে গ্রেফতার করেছি। তারা প্রাথমিকভাবে অপহরণ ও ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। মেয়েটিকে অপহরণ করতে মালা তাদের সহযোগিতা করেছিল বলে জানিয়েছে। আমরা এই সংঘবদ্ধ চক্রের সঙ্গে যুক্ত আরও কয়েকটি নাম পেয়েছি। তাদের গ্রেফতারের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’