আমরা মহামারি-কাল অতিক্রম করছি এবং একইসঙ্গে ঋতু পরিবর্তনজনিত অসুখ হচ্ছে, তাই শরীরে ক্লান্তি ভর করলেই তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে না। আমরা জানি, কোভিড-১৯ এর উপসর্গের সঙ্গে মৌসুমী সংক্রমণের বেশ মিল রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, ক্লান্তির কারণ কোভিড-১৯ নাকি মৌসুমী সংক্রমণ- বুঝবেন কীভাবে?
সংক্রমণ ও জীবনযাপনজনিত ক্লান্তির মধ্যে পার্থক্য
সাধারণত আমরা খুব পরিশ্রম করলে ক্লান্ত হই। এরপর বিশ্রাম নিলে বা খাবার খেলে ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। মূলত বেশি পরিশ্রমে শরীরের শক্তি দ্রুত ক্ষয় হওয়ার কারণে ক্লান্তি অনুভব হয়। যদি আপনি সাত ঘণ্টার কম ঘুমান এবং দিনের বেলা ক্লান্তিতে ভোগেন, তাহলে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলেই শরীরের সতেজতা বাড়বে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে কাজের মান বা উৎপাদনশীলতা বাড়াতে রাতে পর্যাপ্ত ঘুমের বিকল্প নেই। ঘুমের ঘাটতিজনিত ক্লান্তি এড়াতে অবশ্যই পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। ক্লান্তি লাগছে, কিন্তু কোভিড-১৯ বা মৌসুমী সংক্রমণের অন্যান্য উপসর্গ নেই তাহলে এর কারণ হতে পারে জীবনযাপন। হয়তো কম ঘুমিয়েছেন, নয়তো বেশি পরিশ্রম করেছেন, অথবা জীবনযাপনে অন্যান্য অসঙ্গতি।
অন্যদিকে কোভিড-১৯ বা অন্যান্য সংক্রমণ জনিত ক্লান্তি কয়েক ঘণ্টায় দূর হয় না, রোগী যতই পুষ্টিকর খাবার খান না কেন। এমনকি প্রচুর ঘুমালেও। এই ক্লান্তির অবসান হয় ধীরে ধীরে। রোগী যত নিরাময়ের দিকে এগুতে থাকে তার ক্লান্তি তত কমতে থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণজনিত ক্লান্তিতে কাজ করার স্পৃহা থাকে না। রোগীর মনে হয়, তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না। তাই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলুন। এ সময় পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং বিশ্রাম নিতে হবে।
ক্লান্তির সম্ভাব্য কারণ
সংক্রমণ সৃষ্টিকারী জীবাণু শরীরকে আক্রমণ করলে ইমিউন সিস্টেম তাকে প্রতিহত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। এ সময় প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ক্লান্তি অনুভূত হয়। শরীরে সক্রিয় জীবাণু না থাকলেও বিপাক, রক্ত শর্করা ও প্রদাহমূলক প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে এমন স্বাস্থ্য সমস্যায়ও ক্লান্তির উদ্রেক ঘটতে পারে। ক্লান্তির সম্ভাব্য কারণসমূহ হলো কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাস সংক্রমণ, ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ, মৌসুমী সংক্রমণ, অত্যধিক পরিশ্রম, ঘুমের ঘাটতি, ডায়াবেটিস, রক্তশূন্যতা, বাতরোগ, কম ক্রিয়াশীল থাইরয়েড, ক্যানসার, বিষণ্নতা এবং কিছু ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার ও অন্যান্য।
কোভিড-১৯ ও ক্লান্তি
করোনাভাইরাস মহামারির শুরু থেকে প্রচলিত উপসর্গ হলো ক্লান্তি। এটি কোভিড-১৯ এর প্রাথমিক উপসর্গ। ভয়ঙ্কর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টেরও প্রধান উপসর্গ ক্লান্তি। যে কোনো বয়সের কোভিড রোগীদের ক্লান্তিতে ভুগতে দেখা গেছে। করোনাভাইরাস শরীরে প্রচুর ক্ষতি করে। ভাইরাসের আক্রমণে শরীরের যত ক্ষতি হয়, সুস্থ হতে বা ক্লান্তি দূর হতে তত দেরি হতে পারে। অন্যান্য সংক্রমণের তুলনায় করোনাভাইরাসের আক্রমণে বেশি ক্লান্তির আরেকটি কারণ হলো ইমিউন সিস্টেম কর্তৃক অত্যধিক সাইটোকিন নিঃসরণ।
কোভিড-১৯ নাকি মৌসুমী সংক্রমণ?
ঠিক কি কারণে ক্লান্তিতে ভুগছেন বুঝতে হলে উপসর্গ পর্যবেক্ষণে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ ছাড়াও ডেঙ্গু, ফ্লু ও অন্যান্য মৌসুমী সংক্রমণের প্রকোপ চলছে। বর্ষা বা ঋতু পরিবর্তনের সময় সৃষ্ট সংক্রমণের প্রচলিত উপসর্গ হলো জ্বর, শীত লাগা, কাশি, মাথাব্যথা ও সর্দি। আরো দুটি উপসর্গ হলো ক্লান্তি ও গলাব্যথা। কোভিড-১৯ এর প্রচলিত উপসর্গ হলো জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, স্বাদ ও ঘ্রাণ হারানো বা বিকৃতি। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত কিছু লোকের সর্দিও ছিল। দেখা যাচ্ছে, এসব উপসর্গের মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে কেবল উপসর্গ দেখেই বলা কঠিন যে, কোভিড-১৯ নাকি অন্যান্য ভাইরাস সংক্রমণ। আপনাকে উপসর্গের মাত্রাও বিবেচনা করতে হবে।
সাধারণত মৌসুমী সংক্রমণের উপসর্গগুলো মৃদু থেকে মধ্যম প্রকৃতির হয়, অপরদিকে কোভিড-১৯ এর উপসর্গগুলো তীব্র মাত্রার হয়। কোভিড রোগীর মনে হতে পারে যে তার শরীরের শক্তি এতটাই কমে গেছে যে তার পক্ষে কোনো কাজ করা সম্ভব না। কিন্তু মৌসুমী সংক্রমণ হলে ক্লান্তি সত্ত্বেও উদ্যমশক্তি এভাবে হারায় না। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে মৌসুমী সংক্রমণের উপসর্গগুলো ৩-৭ দিনের মধ্যে দূর হয়ে যায়। কোভিড-১৯ মৃদু প্রকৃতির হলেও উপসর্গ চলে যেতে ২ সপ্তাহ লাগতে পারে। তীব্র কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে সুস্থ হতে ৬ সপ্তাহ বা আরো বেশি সময় লাগতে পারে। কারো কোভিড-১৯ মৃদু বা মধ্যম প্রকৃতির হলে তার কাছে উপসর্গগুলো মৌসুমী সংক্রমণের মতো মনে হতে পারে।
এটাও মনে রাখতে হবে, কারো কারো ক্ষেত্রে মৌসুমী সংক্রমণও মারাত্মক পরিণতির কারণ হতে পারে। উপসর্গ দিনকে দিন শোচনীয় হতে থাকলে এটি কোভিড-১৯ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। এ করণে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিৎ।