আশিক, সোহান ও ফিরোজ। তিনটি নাম নয়, এরা অন্তত ২০টি প্রাণ বাঁচানোর নায়ক। শেরপুরের ঝিনাইগাতীতে পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার কাজে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে অগ্রনায়ক হিসেবে কাজ করেছেন তারা। তাদের নেতৃত্বে কোনও ধরনের প্রশিক্ষণ ও সেফটি কিট ছাড়াই উদ্ধার কাজে অংশ নেয় স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবীদের দুইটি দল।
দুর্যোগে সবার আগে জনগণের মধ্য থেকে এগিয়ে আসেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কোনও টাকা-পয়সার জন্য নয়। মানবতার কল্যাণে এগিয়ে আসেন তারা। জীবনকে বাজি রেখে উদ্ধার কাজে নামেন তারা। তেমনি কয়েকটি ঘটনার সাক্ষী শেরপুরের ঝিনাইগাতীর বানভাসি মানুষ। পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সদস্যরা।
চারদিকে অথই পানি। মেঘালয়ের ভারি বর্ষণে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে শেরপুরের নদ-নদী। শুক্রবার (১৭ জুন) ভোর থেকেই শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশী নদীতে দ্বিতীয়বারের মতো ভাঙন শুরু হয়। এতে উপজেলার উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের অন্তত ৪০ গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এসব এলাকার রামেরকুড়া, দিঘীর পাড়, চতলের বেড়িবাঁধ ভেঙে আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ওপর দিয়ে প্রবল স্রোতে পানি প্রবেশ শুরু করে।
উপজেলার মহারশী নদীর পানির তোড়ে শুক্রবার (১৭ জুন) দুপুরে রামেরকুড়া বাঁধের সঙ্গে চার বাড়ি ও দুটি মুরগির খামার ভেসে যায়। সেইসঙ্গে ওই গ্রামের কয়েকটি বাড়ির মানুষ পানিবন্দি হয়ে আটকে পড়ে। স্থানীয়দের খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিম। পাকা সড়কের কাছাকাছি একটি বাড়ি থেকে ছয় জনকে উদ্ধার করলেও প্রবল স্রোতে ভেতরের বাড়িতে পৌঁছাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের টিম।
এদিকে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করতে জীবন বাজি রেখে পানিতে নামে স্কাউট সদস্য আশিক ও স্বেচ্ছাসেবী সোহানের নেতৃত্বে দুটি টিম। স্বেচ্ছাসেবী ফিরোজসহ কয়েকজনের প্রচেষ্টায় উদ্ধার করা হয় শিশু, নারীসহ কয়েকজনকে। পরে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এ উদ্ধার তৎপরতায় নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারুক আল মাসুদ। উদ্ধার কাজে অংশ নেন ঝিনাইগাতী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কর্মী, জনপ্রতিনিধি, স্কাউট সদস্য ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা। তাদের প্রচেষ্টায় ছয় পরিবারের ২৬ জনকে উদ্ধার করা হয়।
নৌকার ব্যবস্থা না থাকায় স্বেচ্ছাসেবীদের কেউ লাইফ জ্যাকেট পড়ে আবার কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাইফ জ্যাকেট ছাড়াই এই উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করে। এসময় পাড়ে থাকা মানুষদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লেও আশীর্বাদের কমতি ছিল না স্বেচ্ছাসেবীদের প্রতি। নদী ভাঙনের ফলে স্বল্প দূরত্বে পানির তোড়ে আটকে পড়া মানুষের কাছে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবীদের। প্রথমে রান্নার বড় হাড়িতে করে শিশু ও নারীদের পাড়ে আনা হয়। পরে স্বেচ্ছাসেবীরাই একটি নৌকার ব্যবস্থা করে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
বৈরাগীপাড়া এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান বলেন, সবাই বেড়াতে যাওয়ায় আমার বাড়িতে আমি একাই ছিলাম। ভোরে হঠাৎ বন্যার পানিতে আমি আটকা পড়ি, ঘরের খাটও পানিতে ডুবে ছিল। সন্ধ্যার আগে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্কাউট সদস্য আশিক ও স্বেচ্ছাসেবী সোহান আমাকে উদ্ধার করে।
রামেরকুড়া এলাকার আক্কাস আলী বলেন, বন্যার পানিতে আমরা খুবই বিপদে পড়েছিলাম। পানির স্রোতে মনে হচ্ছিল বাড়ি ভেঙে নিয়ে যাবে। বিকেলে আমাদের সবাইকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
ঝিনাইগাতী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্য মান্নান বলেন, ঢলের পানিতে সৃষ্ট বন্যায় আটকে পরিবারগুলোকে জনপ্রতিনিধিসহ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরানোর কাজ করা হয়েছে। আমাদের কাজে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শাহাদৎ হোসেন, সদস্য মো. জাহিদুল হক মনির সহযোগিতা করেছেন।
ইউএনও ফারুক আল মাসুদ বলেন, কিছু পরিবার পানিতে আটকে পড়ে। খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
এদিকে শুক্রবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সকল দপ্তরের কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবী, এনজিও, সুশীল সমাজ, স্কাউট, রেডক্রিসেন্টসহ সবাইকে বন্যা মোকাবিলায় সর্বাত্মক আহ্বান জানান জেলা প্রশাসক সাহেলা আক্তার। শনিবার (১৮ জুন) দুপুরে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীদের উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি।