হাতিরঝিল থানায় পুলিশ হেফাজতে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পুলিশের দাবি, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। তবে পরিবারের দাবি, তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করার পর থানার ভেতরে ফ্যানে ঝুলিয়ে রেখে পুলিশ আত্মহত্যার নাটক সাজানোর চেষ্টা করছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী শনিবার (২০ আগস্ট) থানার সামনে বিক্ষোভ করেন।
নিহত তরুণের নাম সুমন শেখ (২৫)। তিনি পশ্চিম রামপুরার ঝিলকানন এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের দাড়িকান্দি এলাকায়। সুমনের বাবার নাম পেয়ার আলী। তিনি রামপুরায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। মালিকের সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় মালিক তাকে পুলিশে দিয়ে হত্যা করিয়েছে বলে সুমনের স্ত্রী জান্নাত আরার অভিযোগ।
জান্নাত আক্তার অভিযোগ করেন, সুমন রামপুরায় ইউনিলিভারের পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইট–এর বিপণন অফিসে ছয় বছর ধরে কাজ করতেন। মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। শুক্রবার রাতে সেখান থেকে পুলিশ তাঁকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়।
ছয় বছরের শিশু সন্তান রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে জান্নাত বলেন, ‘আমার স্বামীকে ধরার পর পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দেওয়ায় ওরা তাকে মেরে ফেলছে। যারা আমার ছেলেকে এতিম করলো, আল্লাহ তাদের বিচার কইরো।’
পরিবারের সদস্যদের দাবি, সুমন শেখকে আটকের কথা শুনে রাতেই তারা থানায় যান। জান্নাত আরা জানান, সুমনের স্বজনরা থানার সামনে কান্নাকাটি করছিল। সে সময় পুলিশ তাদের ধমক দিয়ে বার বার সরিয়ে দেয়। অবশেষে পুলিশ তাদের বলে, সকালে সুমনকে আদালতে পাঠানো হবে। সকালে তারা আবার থানায় গেলে তাদের সুমনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়নি।
হাতিরঝিল থানার সামনে গিয়ে দেখা গেছে, থানার মূল গেট বন্ধ। সুমন শেখের পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয় কয়েক শ বাসিন্দা থানার সামনে বিক্ষোভ করছেন। পুলিশ সদস্য ও গণমাধ্যমকর্মী ছাড়া কাউকে থানায় ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার সাংবাদিকদের জানান, পিওরইটের একটি চুরির মামলায় গ্রেফতার তিন আসামির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সুমনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই অফিস থেকে ৫৩ লাখ টাকা চুরির মামলা হয়েছিল।
তিনি জানান, চুরির ঘটনায় ওই অফিসের বিতরণ ব্যবস্থাপক মোসলেম উদ্দিন মাসুদ বাদী হয়ে ১৫ আগস্ট হাতিরঝিল থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ওই অফিসের কর্মী আল আমিন, সোহেল রানা ও অনিক হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
উপকমিশনার বলেন, ‘তিনজনের দেওয়া তথ্য ও অফিসের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে সুমনকে চিহ্নিত করা হয়। শুক্রবার (১৯ আগস্ট) বিকালে রামপুরা এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাতে তার বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। অভিযান শেষে রাত ১১টার দিকে তাকে থানার হাজতখানায় রাখা হয়। হাজত থেকে সকালে (শনিবার) সুমনকে আদালতে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু রাত ৩টা ৩২ মিনিটে সুমন পরনের ট্রাউজার দিয়ে গলায় ফাঁস দেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। সেই ফুটেজ সুমনের স্ত্রীসহ স্বজনদের দেখানো হয়েছে।’
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় রাতে দায়িত্বে থাকা উপপরিদর্শক (এসআই) হেমায়েত হোসেন ও কনস্টেবল মো. জাকারিয়াকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনার তদন্তে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক, তেজগাঁও অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার রুবায়েত জামান ও মোহাম্মদপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনার মুজিব পাটোয়ারিকে নিয়ে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে থানার সামনে থাকা স্থানীয় একজন বাসিন্দা বলেন, ‘কেউ অপরাধ করলে আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হবে। কিন্তু থানায় আটকে কেন তাকে নির্যাতন করা হবে?’ সুমনের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি দাবি করেন তিনি।
আরেকজন বলেন, ‘থানায় পুলিশ সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে একজন আসামি কীভাবে আত্মহত্যা করেন! পুলিশ কি আমাদের বোকা পেয়েছে?’
শনিবার দুপুরে থানা হাজত থেকে সুমনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র জানায়, ময়নাতদন্ত শেষে সুমন শেখের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।